গাজী গ্রুপ ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে মুখে রা নেই সরকারের, মাজারে একের পর আগুন ভাঙচুর, শাহ পরান (র.) এর মাজারে আক্রমণ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানেনই না। সবচেয়ে আতঙ্কের হল পোশাক শিল্প ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, হাত গুটিয়ে বসে সরকার।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে দেশে দুটি বিষয় নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা চলছে, এর একটি হল পোশাক ও ওষুধ শিল্পে অস্থিরতা, অপরটি মাজারে মাজারে আক্রমণ।
দুটি বিষয় নিয়েই বিস্ময়করভাবে চুপ অন্তর্বর্তী সরকার। যেন কোথাও কিছু হচ্ছে না। অথচ এর একটি ঘটনা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী দুটি ঘরানার মানুষদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, এটি অন্তঃধর্মীয় সংঘাত যেমন সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি উসকে দিতে পারে উগ্রবাদ।
এমনিতেই এখন বাধাহীন রাজত্ব তৈরি হয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের। হরকাতুল জিহাদ থেকে শুরু করে অন্য সংগঠনগুলোও চুপটি করে বসে আছে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বিপদের কথা হল পুলিশ বাহিনী বলতে এখন যা আছে, সেটি এই বাহিনীর কঙ্কাল ছাড়া আর কিছুই নয়। গোয়েন্দা বিভাগও অকার্যকর, এই সুযোগ সংগঠনগুলো নেবে না, সেটা বিশ্বাস না করার কারণ নেই।
বিভিন্ন মাজারে হামলা হচ্ছে। কোথাও শাবল খুন্তি নিয়ে, কোথাও বা বুলডোজার বা এক্সকেভেটর ব্যবহার করে ভাঙা হচ্ছে মাজারগুলো।
ইসলাম ধর্মে কিছু তরিকা আছে, যারা মাজারকে বেদাত মনে করে। আবার যারা মাজারের পক্ষে তারা বলেন সুফি। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে সুফিরাই রেখেছে মূল ভূমিকা। এ কারণে মাজার অনুসারীদের সংখ্যা কম নয় কোনোভাবেই।
আরও একটি রাজনীতি আছে এখানে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মাজার ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। এই দিক দিয়ে রাজনৈতিক বিভেদও আছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ঘোষণা দিয়ে মাজারে আক্রমণের রাজনৈতিক দিক সম্ভবত এটিও।
এমনকি যারা সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলন করেছে, তাদেরও একটি অংশ মাজারে আক্রমণকে ভালোভাবে নিচ্ছে না।
কিন্তু সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস না করলে এসব নিয়ে কোনো কথা বলছেন না উপদেষ্টারা, নিজে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা। আর কথা বললেও সেগুলো স্রেফ বলার জন্য বলা।
যেমন ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেনকে পেয়ে সাংবাদিকরা জানতে চান, হচ্ছেটা কী?
জবাবে তার বক্তব্যটি ছিল আশাব্যাঞ্জক। তিনি বলেছিলেন, “মাজার ভাঙা হোক, মসজিদ ভাঙা হোক, মন্দির ভাঙা হোক, এগুলো গর্হিত কাজ। এগুলো যেভাবে আছে, সেভাবে থাকা দরকার।
“আমরা আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাতে চাই, এরকম যদি কোনো ঘটনা হয় যেখানে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ নষ্ট হবে, আপনারা আমাদের জানালে মুহূর্তের মধ্যে সেটা আইনগত ব্যবস্থা নেব।”
কিন্তু কথা বলেই শেষ, ব্যবস্থা আর নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে সিলেটের বিখ্যাত শাহ পরান (র.) এর মাজার।
৯ সেপ্টেম্বর রাতভর তুলকালামের পরদিন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে বলেন, “শাহ পরানে যে হামলা হয়েছে সে বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে কোনো ধরনের যেন হামলা না হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমার। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
কী নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আল্লাহ মালুম, কারণ এরপরে দুই দিনে আরও বেশ কিছু মাজারে হামলা হয়েছে, সেই ভিডিওগুলো ফেইসবুকে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
মাজার থাকলে বা না থাকলে আর যাই হোক, মানুষের পেটে তো আর টান পড়বে না। কিন্তু পোশাক ও ওষুধ শিল্পে যা হচ্ছে, তা দেশের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। কিন্তু ১০ দিনের বেশি সময় পেরিয়ে গেল পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ দূর করতে সরকারের তরফে কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি।
অথচ এই সময়ে অর্ডারের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাতিল হয়ে গেছে, এই তথ্য খোদ প্রচার করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। প্রশ্ন হল সরকার এখানে করছে টা কী?
গত ৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে ৫ জন উপদেষ্টা মিলে বৈঠক করলেন। এরপর দুই উপদেষ্টা দিলেন দুই ধরনের বার্তা।
শ্রম উপদেষ্টা সেদিন বললেন, “স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগও আছে কিছু জায়গায়, কিছু স্থানীয় বিএনপির নেতারাও রয়েছেন বলে আমরা সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমাদের এ বিষয়ে কথা হচ্ছে, তারা যাতে তাদের নিবৃত্ত রাখেন। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী যেসব আওয়ামী লীগ নেতা এখনও রয়ে গেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে যাব।”
অর্থাৎ এই ঘটনাকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের চক্রান্ত বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করেছে সরকার।
একই দিন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেন, “প্রকৃত শ্রমিক যারা, তারা কেউ নিজের বাড়ি পোড়াবে না, কারণ এখানে তার জীবিকা। এটা বহিরাগতরা এসে করেছে।”
পরদিন থেকে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর অভিযান। গ্রেপ্তার হয় ১৫ জন।
কিন্তু সরকার যে সংকটের ধারেকাছেও নেই, তার প্রমাণ হল এরপর থেকে শ্রমিক অসন্তোষ আরও বাড়ে। একের পর এক কারখানা বন্ধ হতে থাকে, অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে অনির্দিষ্টকালের জন্য।
এর মধ্যে ৯ সেপ্টেম্বর এক কথিত ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় পুলিশ। কিন্তু পরে ফাঁস হয়ে যায় তার গোমর।
গ্রেপ্তার হওয়া ইসতিয়াক আহম্মেদ হৃদয়কে ছাত্রলীগের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির অন্তর্গত নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা কমিটির শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম বিষয়ক সম্পাদক বলে পরিচয় করিয়ে দেন নেত্রকোণার পুলিশ সুপার ফয়েজ আহমেদ।
তার বিরুদ্ধে পোশাক কারখানায় ‘নাশকতার মাধ্যমে’ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ‘উসকানি’র অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বিস্ফোরক আইনে করা দুটি মামলায়।
কিন্তু পরের দিনই গোমর ফাঁস হয়ে যায়। হৃদয়ের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়, যাতে দেখা যায় তিনি ঢাকায় জিয়াউর রহমানের সমাধিতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে বিএনপির পক্ষে বক্তব্য রাখছেন আর সামরিক কায়দায় জিয়াকে উদ্দেশ করে একটি সালাম দেন। এই ব্যক্তি কীভাবে ছাত্রলীগ নেতা হয়, সেটা বোধগম্য নয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী গ্রুপের দুই কারখানা গাজী ট্যাংক ও গাজী টায়ার লুটপাট ও আগুন দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, লুটপাট করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে পড়েছে, একশ বা দুইশ বা তিনশ বা চারশ মানুষ। কিন্তু কারও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কথা বলেননি কেন পুলিশ ঠেকাতে যায়নি, শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টার একেবারে চুপ, যেন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। বাণিজ্য উপদেষ্টার মুখেও কুলুপ, অথচ এখন টায়ার বিদেশ থেকে আনতে হবে, কিন্তু দেশে ডলার সংকট।
শিক্ষাক্ষেত্রে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। মব জাস্টিস বলে একটা কথা ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু শিক্ষার্থী গিয়ে তাদের শিক্ষকদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করছেন। এই কাণ্ডে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত অপমানিত করছেন, হাতুড়িপেটাও করা হচ্ছে।
কিন্তু একটু বকে দেওয়ার মত কাণ্ড করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, যিনি নিজেও একজন প্রথিতযশা শিক্ষক। দুই দিন তিনি কেবল আহ্বান জানিয়েছেন, এভাবে যেন শিক্ষকদের লাঞ্ছনা করা না হয়। কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, এও বলা হয়নি, এভাবে জোর করে পদত্যাগ গ্রহণ করা হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেই, পরীক্ষা নেই। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে গণবিয়ের। সরকার পতনের জন্য আনন্দ করতে চায় তারা। ঘটনাটি বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অভিনব হবে সন্দেহ নেই।
আইনশৃঙ্খলার কথা না বললেই না, চট্টগ্রামে এক কিশোর হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে গিয়ে আরেকজনের এক হাত কেটে নিয়ে এসেছেন, সেই ভিডিও ছড়িয়েছে ফেইসবুকে। কিন্তু সরকারে কোনো রা নেই।
রাজশাহীতে এক দশক আগে শিবিরের হামলায় পা হারানো ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে শিবির কর্মীরা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার রা নেই। শিবিরের কর্মীরা কারা কারা হামলা করেছে, সেটি ভিডিওতে স্পষ্ট। কিন্তু সংবাদ মাধ্যম লিখেছে ‘একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের’ কথা। ওদিকে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, প্রাণ খুলে তার সরকারের সমালোচনা করতে।
আরও বড় বিপদ টেনে আসছে সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা প্রকাশ্যেই ভারতের সেভেন সিস্টার নামে সাত রাজ্য ‘খেয়ে দেওয়ার’ ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন। সেসব ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে যাচ্ছে, ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে, কিন্তু স্বরাষ্ট্র বা পররাষ্ট্র উপদেষ্টা নিরব। প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, এ নিয়ে একটি কথাও বলেননি।
মব জাস্টিস নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূসের বক্তব্যে মনে পড়ে গেছে বাংলা সিনেমার শেষের ডায়ালগ, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’