বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার হাজার হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে লাখো মানুষের গণঅভ্যুত্থানের ফসল।এই সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।
তবে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাতে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে তাদেরও সতর্ক থাকতে হবে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ কিংবা যেকোনো দেশেই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার। তাই জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে, রাখবে। তবে কোনো এক পর্যায়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জবাবদিহিও কিন্তু নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা হয়। সুতরাং জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠাই অন্তর্বর্তী সরকারের সব সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেটও হওয়া জরুরি।
নির্বাচনের লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসনের সংস্কার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ‘সক্ষম এবং উপযুক্ত’ গড়ে তুলতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিএনপি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার এজেন্ডা সেটিংয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে না পারলে গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্য ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্রকারী চক্র নানা সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। এর কিছু আলামত ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, এ জন্যই অগ্রাধিকারভিত্তিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত জবাবদিহিমূলক সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া দরকার। কারণ, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া, সংস্কার কার্যক্রমের প্রক্রিয়ায় জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া উন্নয়ন-গণতন্ত্র বা সংস্কার কোনোটিই টেকসই ও কার্যকর হয় না। একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘এই সরকারের কোনো কোনো কার্যক্রম সবার কাছে হয়তো সাফল্য হিসেবে বিবেচিত না-ও হতে পারে। কিন্তু এই সরকারের ব্যর্থতা হবে বাংলাদেশের পক্ষের গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। এটি আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখতে হবে। সুতরাং এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। দেশ-বিদেশ থেকে নানা রকম উসকানিতেও জনগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ হতে দেবে না।’
এবারের গণ-অভ্যুত্থানের চরিত্র অতীতের যে কোনো গণ-অভ্যুত্থানের চেয়ে ব্যতিক্রম বলে মন্তব্য করেন বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন, এবারের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কেবল মানুষের অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা পেয়েছে। দেশ এবং জনগণ এখন গুম-খুন-অপহরণ আর বিভীষিকাময় ‘আয়নাঘরে’র আতঙ্কমুক্ত, স্বাধীন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পর এবার দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা সুরক্ষায় প্রথম কাজ হতে হবে, রাষ্ট্র এবং সমাজে মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার এবং ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
২০২৩ সালে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা কর্মসূচির উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ঘোষিত ৩১ দফাই শেষ কথা নয়। বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতি, সব ক্ষেত্রেই সংস্কার কার্যক্রম একটি ধারাবাহিক এবং চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং রাষ্ট্র এবং রাজনীতি সংস্কারে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচির আরও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন পরিমার্জনকেও বিএনপি স্বাগত জানায়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, অন্যায়-অনিয়ম আর অরাজকতার বিরুদ্ধে গণ-বিস্ফোরণে মাফিয়া চক্রের প্রধান দেশ ছেড়ে পালানোর পর দেশে মাফিয়া শাসন-শোষণের অবসান ঘটেছে। পতিত স্বৈরাচারের পলায়নের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক-মানবিক বাংলাদেশ গড়ার পথে প্রধান বাধা দূর হয়েছে। তবে বাধা দূর হলেও মাফিয়া চক্রের রেখে যাওয়া ১৫ বছরের জঞ্জাল দূর হয়নি। এই জঞ্জাল দূর করে জনগণের বাংলাদেশে জনগণের ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। তবে মাফিয়া চক্রের প্রধান হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালেও মাফিয়া চক্রের বেনিফিশিয়ারি অপশক্তি প্রশাসনের অভ্যন্তরে থেকে কিংবা রাজনীতির ছদ্মবেশে অন্তর্বর্তী সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ ব্যাপারে তিনি সবাইকে সতর্ক করেন।
তিনি বলেন, এমনকি কেউ যদি মনে করেন একটি উন্নত এবং নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য আরও নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে, তাতেও দোষের কিছু নেই। কারণ, শেষ পর্যন্ত জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে সমর্থন জানাবে কিংবা কাকে সমর্থন দেবে না। এ কারণেই বিএনপি বারবার জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে।
সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সভাপতিত্ব করেন। সমাবেশে স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, এ জেড এম জাহিদ হোসেনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বক্তব্য দেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজকে আমাদের সামনে একটা সুযোগ এসেছে, ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা সুযোগ পেয়েছি একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। সবাইকে অনুরোধ করব, সুযোগটা যেন হেলায় না হারাই।’ উপস্থিত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা হচ্ছেন গণতন্ত্রের ভ্যানগার্ড, পাহারাদার। সে জন্য গণতন্ত্রকে কেউ যদি ধ্বংস করতে চায়, আবার বিপথে নিতে চায়, সেখানে অবশ্যই আপনারা রুখে দাঁড়াবেন।
পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের অনেক প্রেতাত্মা এখনো সরকারে অবস্থান করছে জানিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সতর্ক করেন মির্জা ফখরুল।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিগত ১৬ বছরের আন্দোলনে ১ হাজার ৫৫১ জন আত্মাহুতি দিয়েছেন।
গুমের শিকার হয়েছেন ৪২৩ জন, প্রায় দেড় লাখ মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ প্রায় ৬০ লাখ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এসব ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ স্বৈরাচার, লুটেরামুক্ত হয়েছে; কিন্তু জনগণের অধিকারের এখনো ফয়সালা হয়নি। সেই অধিকারের প্রধান হচ্ছে জনগণের ভোটের অধিকার। সেই অধিকার আমরা ফিরে পেতে চাই।’
বিএনপি নেতা সুলতান সালাউদ্দিন, আমিনুল হক ও তানভীর আহমেদের পরিচালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম, ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির, হাবীব উন নবী খান ও শহীদউদ্দীন চৌধুরী। এ ছাড়া জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল, মহিলা দল ও কৃষক দলের শীর্ষ নেতারাও বক্তব্য দেন।
বেলা আড়াইটায় আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ শুরু হলেও নেতা-কর্মীরা দুপুর থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নয়াপল্টনে জড়ো হতে থাকেন। একপর্যায়ে সমাবেশ নয়াপল্টন ছাড়িয়ে কাকরাইল মোড়, নাইটিঙ্গেল হয়ে বিজয়নগর, ফকিরাপুল, পুরানা পল্টন এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। নেতা-কর্মীরা রাস্তা দখলে নিলে দুপুরের আগেই নয়াপল্টনের ভিআইপি সড়কের দুই পাশেই সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকেলের দিকে বিজয়নগর সড়কেও যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। ফলে পুরানা পল্টন, কাকরাইল, শান্তিনগরসহ আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়। এর প্রভাব পড়ে রাজধানীর অন্যান্য সড়কেও। এ কারণে অফিসফেরত মানুষদের দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়।

previous post