সিরাজুল হোসেন, লেখক
বেশ উচ্চ বেতনে গবেষণা সমন্বয়কের একটি পদে নিয়োগের আবেদন করা হল। অনেক মেধাবী ও পরীক্ষা ভাল ফল করা ছেলে মেয়ের আবেদনপত্র পাওয়া গেল। নানা যাচাই বাছাই করে দশ জনের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হল। সেখান থেকে দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে প্রাক নির্বাচিত হল। তাদের বলা হল তাদের কোন গবেষণা পত্র থাকলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা যে থিসিস জমা দিয়েছে সেগুলো পাঠাতে।
সেরা এবং বাছাই করা স্মার্ট এইসব ছেলে মেয়ের থিসিস বা গবেষণাপত্র পড়ে চক্ষু চড়কগাছ। কঠিন কঠিন নানা তত্ত্ব নিয়ে এসে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন লম্বা গবেষণাপত্র লিখা হয়েছে কিন্তু অনেকে মূল বিষয়টাই বোঝেনি, অথবা এমন বিষয় সংযুক্ত করেছে যেগুলো প্রাসঙ্গিক নয়। এটা পরিষ্কার যে সুন্দর কোন পেপার দেখে নানা বিষয় সংযুক্ত করে দেখতে সুন্দর একটি পেপার তৈরী করা হয়েছে যেটার কনটেন্ট ও কনটেক্সটের মেরিট শূন্য। আশ্চর্য যে যে সব শিক্ষক এগুলো রিভিউ করেছেন বা তাদের এগুলোর উপর ভিত্তি করে উচ্চ স্কোর দিয়েছেন তারাও নিশ্চই না বুঝেই সেটা দিয়েছেন।
আমার বড় ভাতিজী যখন জন্ম নিল তখন প্রায় প্রতিদিনই অফিসের কাজ সেরে আমাদের পারিবারিক বাসায় যেতাম। আমার মা তখন প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন, তাঁর সাথে দেখা হত আর ছোট্ট ভাতিজীটা ছিল আনন্দের উৎস কারণ সে খুব সপ্রতিভ ও হাসিখুশি, ছটফটে ছিল। তখন আমার যে কলমটি ছিল তার সাথে ছিল একটি লেজার পয়েন্টার। যখন সেই ছোট্ট ভাতিজীটা মেঝেতে হামাগুড়ি দিত, তখন তার সামনে লেজার পয়েন্টারটির আলো ফেললে সে ওটাকে উজ্জ্বল লাল কোন বস্তু মনে করে ধরতে যেত।
এর বেশ কিছুদিন পর বাসায় যখন ছোট্ট একটি কুকুর ছানাকে নিয়ে এলাম, তার সামনে লেজার পয়েন্টারটির আলো ফেললেও সে গভীর মনোযোগে সেটিকে অনুসরণ করত এবং একটা ভুক শব্দ করে থাবা দিয়ে ধরতে চাইত।ঘরের দেওয়ালে যে টিকটিকি বাতির কাছে পোকা ধরে বেড়ায়, তার সামনে ঐ লেজার পয়েন্টারটির আলো ফেললে টিকটিকিটি সেটিকে পোকা মনে করে ধরার জন্য দৌড়াতো। এটি দেখে আমার ভাতিজী খুব মজা পেত আর আঙুল দিয়ে দেখাত আর বলত ‘টিক’। তখন সে টিকিটিকিকে বলত ‘টিক’।
আমার ছোট্ট ভাতিজীটা দ্রুতই বুঝতে পারল যে এটা আলো এবং এটা কোথা থেকে আসছে। তখন সে নিজের হাতে লেজার পয়েন্টারওয়ালা কলমটা পেতে চাইত নিজেই আলো ফেলার জন্য। কুকুরের বাচ্চাটা কয়েকদিন পর এই দুষ্ট ‘লাল পোকাটার’ প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। দেয়ালের টিকটিকিটা কিন্তু কখনও শেখেনি যে এটা পোকা নয়। প্রথম দিন সে যেমন অতি আগ্রহের সাথে লেজার পয়েন্টারটির আলোকে ধরতে চেয়েছে, তার সব সময় তেমনই চেয়েছে। তার চোখ এবং তার মস্তিষ্কের চোখ থেকে আসা সেই সংকেত বিশ্লেষণ শুধুই দ্বিমাত্রিক তলে পোকামাকড় ধাওয়া করার জন্য তৈরি। দূর তৃতীয় মাত্রা থেকে কোন আলোর প্রক্ষেপন বিশ্লেষণ করা তার হিসাবের বাইরে।
পোকা সাদৃশ্য কিছু দেখলে টিকটিকি, যে একটি সরীসৃপ, সে কি আচরণ করবে সেটা তার মগজে স্থায়ীভাবে লেখা বা হার্ডওয়্যারড। তাই লেজার আলোর ডট যে পোকা নয় সেটা সে ধরতেই পারে না। কুকুর, যে একটি স্তন্যপায়ী, তার মস্তিস্কে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তার আচরণে পরিবর্তন আনতে পারে। তাই লেজার আলোর ডটটার প্রতি সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ধরা যাচ্ছে না সেই পোকাটা কি সেটা নিয়ে সে চিন্তা করে না কারণ তার সেই মগজটাই নাই। কগনিটিভ (চিন্তাপ্রক্রিয়াসম্পন্ন) দক্ষতা সম্পন্ন স্তন্যপায়ী প্রাইমেট মানুষ লেজার ডটটা যে লাল কোন বস্তু নয় সেটা তো দ্রুতই শেখে তার সাথে সেটার উৎস কি সেটাও দ্রুত ধরে ফেলে।
কয়েকদিন আগে আফ্রিকার কঙ্গোর কেঙ্গা নামে একজনের কথা লিখেছিলাম। পরিবেশগত কারণে যাদের পুরো সমাজের দৃষ্টি ও মস্তিস্কের দৃষ্টি তথ্য প্রক্রিয়াকরণের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আফ্রিকার কঙ্গোর (ডিআরসি) উত্তরে গভীর ইতুরি রেইন ফরেস্টের ভেতরে বাস করে ব্যাম্বুতি পিগমি জাতি যারা এখনও মূলত শিকারি সংগ্রাহক (হান্টার গ্যাদারার)। এদের সারা জীবন গভীর জঙ্গলে কাটে যে জঙ্গল ৭০,০০০ বর্গ কিলোমিটারব্যপী বিস্তৃত। এই জঙ্গল এতই ঘন যে গাছের কারণে ১০-১৫ ফুটের বেশি কোন দিকেই দৃষ্টি যায় না। প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে তারা কখনও এর চেয়ে বেশী দুরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেনি।
১৯৫০-৬০ এর দিকে কলিন টার্নবুল নামে এক ব্রটিশ-অ্যামেরিকান অ্যানথ্রোপোলজিস্ট ইতুরি রেইন ফরেস্টের ভেতরে বাস করা ব্যাম্বুতি পিগমিদের নিয়ে গবেষণা করতে যান। কেঙ্গা নামে একজন তরুণ ব্যাম্বুতি পিগমিকে গবেষক টার্নবুল তার সহকারী নিযুক্ত করেন। একদিন টার্নবুলের সাথে কেঙ্গা বনের প্রান্তে চলে আসে যেখান থেকে দুরের পাহাড় দেখা যায়। কোনদিন দুরের পাহাড় না দেখা কেঙ্গা পাহাড় দেখে প্রশ্ন করে মেঘগুলো মাটিতে নেমে গেছে কেন?
আর একবার কেঙ্গা যায় এমন খোলা যায়গায় যেখানে দুরে কতগুলো মহিষ চরছিল।
কেঙ্গা সেগুলো দেখে প্রশ্ন করে এগুলো কি পোকা? সারা জীবন যারা ১০-১৫ ফুটের বেশী দেখেনি তাদের মস্তিস্ক পার্সপেক্টিভ থেকে দূরত্ব পরিমাপের সিনারজিস্টিক প্রক্রিয়াকরণ শেখেনি। টার্নবুল বলে এগুলো পোকা নয় এগুলো মহিষ, দুরে আছে তাই এগুলো ছোট দেখাচ্ছে। কেঙ্গা সেটা বিশ্বাস করতে চায় না। কেঙ্গার ভুল ভাঙাতে টার্নবুল যখন তাকে হাঁটিয়ে মহিষগুলোর কাছে নিয়ে যায় তখন বিস্মিত হয় কেঙ্গা। সে বলে কোন জাদুর বলে তুমি পোকাকে মহিষ বানিয়ে ফেললে? দুরের জিনিষ দেখেনি বলে কেঙ্গার মস্তিস্কে পরিপ্রেক্ষণ (perspective) ও দুরত্বের নিত্যতা (constancies) তৈরি হয়নি।
এই সীমাবদ্ধতা শুধু আফ্রিকার কঙ্গোর কেঙ্গা নয়, আমরা যারা মায়ের তলপেটের ভেতরে জরায়ুতে জীবনের প্রথম নয় মাস কাটিয়েছি তাদের সবারই ছিল। একটি শিশু জন্মগ্রহণের পর তার চোখ যান্ত্রিকভাবে পুরোপুরি সক্ষম হলেও তার মস্তিস্কের চোখ থেকে আসা তথ্য বিশ্লেষণের জন্য প্রস্তুত থাকে না যেহেতু মায়ের জরায়ুতে প্রায় অন্ধকারে যে ছোট্ট থলিতে সে জীবনের শুরু থেকেই ছিল।
তার সারা জীবনটাই ছিল অনেকটা সেই আফ্রিকার কঙ্গোর কেঙ্গাদের মত যেখানে দূরের কিছু দেখার নেই। তাই দূরের তথ্য প্রক্রিয়াকরণেরও কোন প্রয়োজন পড়েনি। শিশুর জন্মের পর তার দৃষ্টি পরিষ্কার হতে তাই আরো মাস খানেক সময় লাগে। রঙের পার্থক্য বুঝতে লাগে আরো দুই তিন মাস। কাছে না দুরে এটা বুঝতে তার আরো লাগে চার থেকে ছয় মাস। এর আগে সে কোন কিছুর জন্য হাত বাড়ায় না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যান্ত্রিকভাবে আমাদের শরীর সক্ষম হলেও উচ্চতর বা জটিলতর সিনারজিস্টিক তথ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য আমাদের মস্তিস্ককে পরিবেশ থেকে সেটা শিখতে হয়। হাত মাথা সমন্বয় (হ্যান্ড আই কো-অর্ডিনশন) এর মত দৃষ্টি তথা অনুভূতি-বোধ সমন্বয়ও মস্তিস্কের একটি দক্ষতা অর্জন। পরিবেশগত বা অন্য কোন কারণে এই দক্ষতা অর্জন যদি কেউ না করে থাকে তাহলে কেঙ্গাদের মত সে বয়সে বা চিন্তায় যত পরিণতই হোক, সেই অদক্ষতা তার থেকে যাবে এবং সেই অদক্ষতা তার চিন্তা ও জীবন যাপনকে প্রাভাবিত করবে।
ছয় বছর বয়সের মধ্যেই শিশুরা ইন্দ্রিয় অনুভব এবং তার নানা প্রত্যঙ্গ ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করে ফেলে। তখন শুরু হয় তার আবেগ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার সময়। এই সময়ই মিথ্যা বলা, খুশি, রাগ, মান অভিমান বা আবেগ দিয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা অর্জন করে। অর্থাৎ এই প্রথম সে ভাব ব্যবহার করে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ করা শেখে।
এই সময় থেকে সে ইন্দ্রিয় জগতের অতিরিক্ত একটি ভাবের জগত আবিষ্কার করে যেটা মানুষের উপর ক্রিয়াশীল। এর সাথে সাথে সে নিজেকে, অর্থাৎ আত্মকেও আবিষ্কার করতে থাকে এবং সে হয়ে ওঠে আত্মকেন্দ্রীক। ১৪-১৫ বছর বয়সে সে এই আত্মকেন্দ্রীকতার চরমে পৌঁছায় এবং সব কিছুকে সে নিজের দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করতে চায়। তার এই নিজস্ব দৃষ্টিকোন গড়ে ওঠে জন্ম থেকে সে যে পরিবেশে বাস করেছে সেই পরিবেশের সীমাবদ্ধতা ও হাওয়ায় ভাসা ধারণাগুলোর উপর ভিত্তি করে।
মায়ের জরায়ুতে শিশুর আত্মই ছিল মহাবিশ্ব। জন্ম নিয়ে সে প্রস্তুত করল নিজেকে বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ, অনুভবের বস্তুজগৎকে। ভাব জগতের সন্ধান পেয়ে আবার সে ঢুকে পড়ল আত্মর ভেতরে। দুনিয়াকে আবার সে দেখা শুরু করল নিজ, অথবা পরিবার অথবা গোষ্ঠী বা দলের অবস্থান থেকে। সে জানে না যে তার এই নিজ, পরিবার, গোষ্ঠী বা দলের অবস্থান থেকে দেখা সত্য সত্য নয়, এটি একটি দৃষ্টিকোন মাত্র। পৃথিবীর কোন বস্তু, মানুষ বা ঘটনা আমরা আসলে দেখতে পাই না – আমরা সেগুলোর একটা দৃষ্টিকোন দেখতে পাই মাত্র।
এই লেখার সাথে দেওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি সিলিন্ডারের টুকরোকে দু’দিক থেকে কৌনিকভাবে কাটা হয়েছে। তিন দিক থেকে আলো ফেললে এই একই বস্তুর বা বাস্তবতার তিনটি দৃষ্টিকোন থেকে তিনটি প্রক্ষেপ দেখা যায় যার একটি হল বর্গাকার, একটি বৃত্তাকার ও একটি ত্রিভুজাকার। এই তিনটির কোনটিই বাস্তবতার সম্পূর্ণ প্রকাশ নয়। কিন্তু আত্মকেন্দ্রীক কৈশোর মন নিজের দৃষ্টিকোন থেকে দেখা প্রক্ষেপ বা প্রতিবিম্বকে সত্য ভেবে সেটির চর্চা ও প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে থাকে।
এই ছবিটির মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে জ্ঞান অর্জন ও প্রশিক্ষণের তফাত। খেয়াল করতে হবে আমরা কখনই কোন বস্তু, মানুষ বা ঘটনার সম্পূর্ণ রূপটি (ছবির দু’দিক থেকে কৌনিকভাবে কাটা সিলিন্ডারের টুকরোটিকে) দেখতে পাই না। আমরা শুধু নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোন থেকে কোন প্রক্ষেপ দেখতে পাই মাত্র। প্রকৃত জ্ঞান অর্জন হল বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে ধারণা নিয়ে অদৃশ্য বাস্তবতাকে বোঝার চেষ্টা করা। আর প্রশিক্ষণ হল নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোনের প্রক্ষেপিত প্রতিবিম্বটিকে আরো স্পষ্টভাবে দেখার চেষ্টা করা।
আমাদের ইন্দ্রিয় সীমাবদ্ধতা, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে আমরা যেহেতু শুধু নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোন থেকে কোন প্রক্ষেপ দেখতে পাই মাত্র, এটি কখনই আমাদের সামনে প্রকৃত সত্য তুলে ধরে না, সেটা কোন বস্তু, মানুষ বা ঘটনা যাই হোক না কেন। ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি বা আত্মবাদী (সাবজেক্টিভ) ভ্রান্তী, দলগত দৃষ্টিভঙ্গী এবং প্রচলিত সংস্কার আমাদের প্রাভাবিত করে নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোনকেই সঠিক ও বাস্তব ভাবতে।
প্রায় চার হাজার বছরে আগে আমাদের এই উপমহাদেশের বৈদিক পন্ডিতেরা জানতেন যে সত্য ও তার প্রক্ষেপিত রূপ এক নয়। সত্যের প্রক্ষেপিত রূপকে তারা নাম দিয়েছিলেন ‘মায়া’ যার অর্থ যাদু নয়, বিভ্রম। তারা বলে গেছেন এই বস্তুনির্ভর পৃথিবী-প্রকৃতি সেই মায়া দ্বারা রচিত।
নিজ চোখে আপনি এক টুকরো বরফ দেখলেন যা স্পর্শ করে দেখলেন প্রস্তর কঠিন, তাপমাত্রা বাড়লে সেটি হয়ে গেল প্রবাহিত পানি যার কোন আকার নেই। আর একটু তাপমাত্রা বাড়লে সে হয়ে গেল বাষ্প যার কোন আরা নেই আয়তন নেই। দুনিয়ার সকল বস্তু ও ঘটনা পরিবর্তনশীল তাই সব কিছুই মায়া – কোন কিছুই চরম সত্য নয়।
সত্যকে পেতে হলে মায়া সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। নানা প্রক্ষেপন থেকে সত্যকে মনে ধারণ করতে হবে যেটাকে তারা বলেছেন বিদ্যা। মাত্র একটি প্রক্ষেপণ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞানকে তারা বলেছেন অবিদ্যা। ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে:
“অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেঽবিদ্যামুপাসতে৷
– ঈশোপনিষদ (৯)
যার অর্থ “যারা অবিদ্যা অনুশীলন করে, তারা অজ্ঞানের ঘোর অন্ধকারময় লোকে প্রবেশ করে”৷
অবিদ্যা কিন্তু অজ্ঞানতা নয়। অবিদ্যা হলো সত্যের একটি প্রক্ষেপণকে সত্য বলে মনে করা। আমাদের ছবির উদাহরণে দু’দিক থেকে কৌনিকভাবে কাটা সিলিন্ডারটিকে বর্গাকার, বৃত্তাকার বা ত্রিভুজাকার ভেবে সেটি নিয়ে সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতমভাবে জ্ঞানচর্চা করা।
এই জ্ঞানই হল অবিদ্যা যা বস্তুগত ও ইন্দ্রিয় উপভোগের উৎকর্ষতা আনতে পারে কিন্তু সেটি আমাদের ঘোর অন্ধকারময় স্থানে নিয়ে যাবে। বিশাল বিশাল ডিগ্রি নিয়ে বিরাট গবেষক, প্রফেসর বা বিজ্ঞানী হয়ে একই ঈশ্বরের বর্গাকার, বৃত্তাকার বা ত্রিভুজাকার রূপ নিয়ে যুদ্ধ বিবাদ এই সত্যের প্রমাণ।
বৈদিক পন্ডিতেরা চারটি বিষয়ের কথা বলেছেন সংসার, কর্ম, আত্মা ও ব্রহ্ম। যেখানে কর্মের মাধ্যমে সংসারধর্ম পালন করতে হয় যা আমাদের এই মায়ার জগতে ক্ষণস্থায়ী জীবনযাপনে সহায়তা করে।
বিদ্যা ও জ্ঞানের চরম সত্তা হল ব্রহ্ম। ব্রহ্ম সত্যের অপর নাম এবং তার এক একটি একটি প্রক্ষেপণ হল এক একটি বাস্তবতা বা সংসার যা বিভিন্ন রূপ নিয়ে ধরা দেয়।
তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে:
‘সত্যম্, জ্ঞানম্, অনন্তম ব্রহ্ম’
– তৈত্তিরীয় উপনিষদে ২:১:২
– অর্থাৎ ব্রহ্ম হল সত্য-জ্ঞান-অনন্ত।
প্রতিটি মানুষের মধ্যও তার একটি মায়া রূপ আছে যেমন তার দেহ, ইন্দ্রিয়, কর্মস্পৃহা ইত্যাদি। আবার তার একটি বিশুদ্ধরূপ আছে যেটি হল আত্মা। এই আত্মা ভুত প্রেত বা প্ল্যানচেট করার আত্মা নয়। এই আত্মা হল প্রকৃত জ্ঞান যা প্রস্ফুটিত হলে ব্রহ্মের সাথে মিলে যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদে যেমন বলা হয়েছে:
“অহং ব্রহ্মাস্মি”
অর্থ “আমিই ব্রহ্ম, বা আমি পরম সত্য”
কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানের অনুসারীরাই শুধু সেই পথে যেতে পারেন যেখানে তিনি এবং ব্রহ্মের মধ্যে কোন তফাৎ থাকে না কারণ তিনি কোন ঘটনার সকল প্রক্ষেপণ মিলে যে সত্য হয় সেটি দেখতে পারেন। তাই তার মনে থাকে না কোন বিভেদ। কিন্তু জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্য যদি কর্মে সাফল্য বা সংসারে ফললাভ যেমন অর্থ, ক্ষমতা, সুনাম বা আরাম আয়েশ, ইন্দ্রিয় উপভোগের লক্ষ্যে হয় তাহলে সেটা অবিদ্যা এবং তার আত্মা কখনই ব্রহ্মের (পরম জ্ঞানের) নাগাল পাবে না যার ফলে শান্তি, প্রশান্তী ও অন্তরের পরিতৃপ্তি আসে।
যেমন ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে:
“অন্যদেবাহুর্বিদ্যয়া অন্যদাহুরবিদ্যয়া।
ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে”
– ঈশোপনিষদ (১০)
“অবিদ্যার পথ এবং বিদ্যার পথ ভিন্ন ভিন্ন ফল উৎপন্ন করে। জ্ঞানী ব্যক্তিরাও এই কথা বলে থাকেন”।
তবে ঈশোপনিষদে আরো বলা হয়েছে শুধু শুষ্ক বিদ্যাচর্চা করেও ব্রহ্মের (পরম জ্ঞানের) নাগাল পাওয়া যাবে না। তারাও ঘোরতর অন্ধকারময় স্থানে পরিণতি লাভ করবে।
“ততো ভূয় ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতাঃ”
– ঈশোপনিষদ (৯)
“যারা তথাকথিত বিদ্যা অনুশীলনে রত, তারা আরও ঘোরতর অন্ধকারময় স্থানে পরিণতি লাভ করে”।
বিদ্যা অর্জনে নির্দেশিত হয়েছে সংসার জীবনের মায়ার জগতে বাস্তবতার যে নানা প্রক্ষেপণ, সকল প্রক্ষেপণকে ধারণ করে আত্মাকে ক্রমেই মোহমুক্ত ও সংস্কার মুক্ত করা।
আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা কিন্তু একই। কোন বিশেষ তত্ত্ব বা পদ্ধতি শেখা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মূল কাজ নয়। নানা বৈপরিত্যের সংঘাতমূলক তত্ত্ব থেকে নিজের বোধকে পরিষ্কার করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উদ্দেশ্য।
অথচ আমরা আমাদের দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে এই লেখার সাথের ছবিটির কৌনিকভাবে কাটা সিলিন্ডারটিকে মনোজগতে ধারণ করতে না শিখিয়ে সিলিন্ডারটির বর্গাকার, বৃত্তাকার বা ত্রিভুজাকার রূপ কে কত দক্ষভাবে আঁকতে পারে বলতে পারে সেই অবিদ্যার চর্চার পথে নিয়ে গেছি। জাতি কেন ঘোরতর অন্ধকারময় স্থানে যাত্রা করেছে সেই প্রশ্নের জবাব চার হাজার বছর আগেই দেওয়া আছে।