New York Bangla Life
বাংলাদেশ

আইএসআই-সিআইএ এর ফাঁদে বাংলাদেশ

পাকিস্তানে মুজিব ভীতি এবং বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রীলংকা পরিণতি
————
বাংলাদেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে শোক প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। গত শুক্রবার (২৩ আগস্ট) তারিখে তার অফিসিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া এক টুইটে তিনি বলেন, “কঠিন এই সময়ে বাংলাদেশি জনগণের পাশে আছে পাকিস্তান”। এটা খুবই সুখের কথা। প্রতিবেশী না হলেও আঞ্চলিক রাষ্ট্র এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ থেকে এমন মনোভাব নিশ্চয়ই প্রেরণার।

তার দু’দিন আগে (২১ আগস্ট) ইসলামাবাদে ন্যাশনাল ইয়ুথ কনভেনশনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, “যিনি পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি অবশেষে তার করুণ পরিণতি ভোগ করেছেন”। শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভাংচুরের প্রসঙ্গে শাহবাজ শরিফ বলেন, “যিনি খারাপ কাজ করবেন তার ফল ঘুরেফিরে তার ওপরই পড়বে। শেখ মুজিবুর রহমান এই অবিভক্ত পাকিস্তানকে দুই ভাগ করেছিলেন”।

২১ আগস্ট বাংলাদেশের একটি কালো দিন। এই দিন শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা এবং তার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লিগের নেতৃত্বকে গ্রেনেড আক্রমণ করে শেষ করে দেবার চেষ্টা করা হয়। উক্ত পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত বিএনপি সরকারের একই দলের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে ১০ ট্রাক অস্ত্র সরবরাহের চেষ্টাও ফাঁস হয়। ২১ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাসবাদ প্রবেশ করানোর দিন। ২১শে আগস্ট না হলে আয়নাঘরের প্রয়োজন হত না।

ভিন্ন একটি দেশের জাতির পিতা সম্পর্কে অপর একটি দেশের পদে থাকা প্রধানমন্ত্রীর এরকম ঘৃণা বক্তব্য সকল কুটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন। হঠাৎ করে তিনি এটা কেন বললেন? তাঁর কথার ভাষা প্রমাণ করে যে তিনি ক্ষুব্ধ এবং রাগান্বিত। সেটা না হল মানুষ কুটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন করে অর্ধশত বছর আগে মৃত একজন রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে এমন কথা বলে না। সাধারণত এমন আচরণের পেছনে থাকে ভয়। কিসের ভয় শেহবাজ শরীফের? অর্ধশত বছর আগে মৃত একজন বাঙালীকে এখনও এত ভয় কেন?

কারণ আছে। শেখ মুজিবর রহমান নামটি এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে নয়া আতঙ্ক। গত গত ২৭শে মে ইমরান খানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (পূর্বের টুইটার) অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা হয়েছে, “প্রত্যেক পাকিস্তানির উচিত ‘হামুদুর রহমান কমিশন’ রিপোর্টটি পড়া, যাতে করে তারা জানতে পারেন যে প্রকৃত দেশদ্রোহী আসলে কে ছিল? জেনারেল ইয়াহিয়া খান নাকি শেখ মুজিবুর রহমান?”

এর আগে এপ্রিলের শুরুতে ইমরান খান বলেন “আরেকটি ‘ঢাকা ট্র্যাজেডি’র পথে পাকিস্তান”। তিনি আরো বলেন, “আপনি যখন জনগণকে তাদের অধিকার দেবেন না, তখন আপনি বলতে পারবেন না অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। ১৯৭০ সালে সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান ঝুলন্ত সংসদ চেয়েছিলেন, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের দল যখন স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল, তখন সেনাবাহিনী জালিয়াতি করে উপনির্বাচন করে, যাতে ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছিলেন। আর এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ৮০টি আসন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল”।

তিনি আরও বলেন, “আমি হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, আমরা অতীতে যে ভুলগুলো করেছিলাম, এখনও সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছি। ১৯৭০ সালেও লন্ডন পরিকল্পনা ছিল এবং আজ আবারও লন্ডন পরিকল্পনার মাধ্যমে (জনগণের ওপর) সরকার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

এখানেই শেষ নয়। এর পর থেকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সভাগুলো ভরে উঠেছে শেখ মুজিবের ছবি আর বক্তব্যে। শেখ মুজিবের ভাষণ উর্দুতে অনুবাদ করে এমনকি বাংলাতেও বাজানো হচ্ছে পাকিস্তানের মিটিং, মিছিল, সভায়। অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যম ভরে গেছে শেখ মুজিবের ভাষণ ও বক্তব্যে। সরকার ও সামরিক বাহিনী বিরোধীদের দেখা গেছে পাকিস্তানের সেনানিবাসের দেয়াল ভাঙছে শেখ মুজিবের ছবি সাথে নিয়ে মিছিল করে। মুজিব ভীতি কিন্তু অমূলক নয়। পাকিস্তানীদের জন্য এটা বিশাল অপমান ও দ্বিতীয় পরাজয়ের সমান। এটা বন্ধ না করতে পারলে পাকিস্তান “আবার ভেঙে দুই ভাগ হবে” হলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইমরান।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এখন এক দলে শেখ মুজিবের চরিত্র হননে। এটা না করলে উভয়েরই সামনে বিপদ। তাই তারা চেয়েছে শেখ হাসিনার চরিত্রহনন করে, তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে। এতে ব্যবহৃত হয়েছে আইএসআই-সিআইএ এর কৌশলে ছাত্রদের মাঝে এম্বেডেড সন্ত্রাসী সেল তৈরি করে, মোবাইল অ্যাপ ও সামাজিক মাধ্যম সেই গ্রুপ ব্যবহার করে, কিশোর গ্যাংকে নিয়োজিত করে সারা বাংলাদেশে শিশু কিশোরদের পুলিশের গুলির মুখে এগিয়ে দিয়ে সরকার পতন সফল করা।

পরবর্তীতে সেই একই কৌশল ও একই সন্ত্রাসী সেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তারা শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙ্গা, শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার প্রতিকৃতিগুলোর উপরে প্রস্রাব করে তার ভিডিও ছড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে। এসবই করা হয়েছে অর্থের বিনিময়ে বাঙালী কিশোর তরুণদের ব্যবহার করে। এর সাথে নির্দেশ দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার সকল নিদর্শন ধ্বংস করতে এবং ধুলোয় মিশিয়ে দিতে। এগুলো সবই সামরিক ট্যকটিক, আইএসআই-সিআইএ এইসব ট্যাকটিক সম্পর্কে অভিজ্ঞ। জামাত বিএনপির ক্যাডাররা ছিল সহযোগী ফোর্স।

শেখ হাসিনার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীতল সম্পর্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলের যে ভূরাজনৈতিক কৌশল, সেটাও এই পরিকল্পনার সাথে সমলয়ী হয়। তার ফলে এতে আমেরিকানদের চার দিকেই লাভ হয়। এক, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও সরকারকে রক্ষা করা হয় যাদের সাথে তাদের সম্পর্ক মধুর, দুই, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাথে নতুন কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করার সুযোগ তৈরি হয়, তিন, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে ভারত-মিয়ানমারকে চীনের যোগাযোগ ও জ্বালানি কৌশল তৈরিতে বাধা দেওয়া যায় এবং চীন মিয়ানমার জ্বালানি পাইপলাইনের খবরদারি করা যায়।

পাকিস্তানের এটিতে সরাসরি দুটি লাভ। এক হল মুজিবের চরিত্রহনন করে পাকিস্তানকে রক্ষা করা এবং দুই বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ তৈরি করে ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদে সহায়তা করে ভারতকে বিপর্যস্ত রাখা। এই কারণেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে আটক সন্ত্রাসীদের ও দাগী অপরাধীদের। খুলে দেওয়া হচ্ছে ইসলামী সন্ত্রাসবাদের রাজনীতির সকল দুয়ার।

কিন্তু পাকিস্তানের আর একটি লুকানো এজেন্ডা আছে। আমার কাছে মনে হয় অর্থনৈতিক সমস্যায় বিপর্যস্ত পাকিস্তান সেটা বাস্তবায়নেই সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। সেটা হল বাংলাদেশে প্রাক্তন সরকারের সমর্থকদের সরিয়ে দেয়ার নামে ব্যপক রদবদল করে প্রশাসনকে অকার্যকর করা। এর সাথে রেজিম চেঞ্জে ছাত্রদের মাঝে যে এম্বেডেড সন্ত্রাসী সেলগুলো তৈরি হয়েছিল, তাদের ব্যবহার করে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে অরাজকতা তৈরী করা। এতে বাড়বে সামাজিক অসন্তোষ এবং বাড়বে হানাহানি ও গৃহযুদ্ধসম পরিবেশ।

সম্প্রতি অল পাকিস্তান টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (এপিটিএমএ) নেতা ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ড. এজাজ গোর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষিতে বলেছেন, “পশ্চিমা পোশাকের ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে অন্যত্র চলে যাচ্ছে, আর সেই সুযোগে পাকিস্তানের টেক্সটাইল খাত পাঁচ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার লুফে নিতে পারে”। হ্যাঁ তিনি ঠিক বলেছেন। উপর মহলে আলাপ নিশ্চই হয়েছে। বাংলাদেশে যদি অরাজকতা, অস্থিতিশীলতা, গভর্নেন্স ফেইলিওর চালু রাখা যায় এবং এর ফলে দেশটাকে বিদেশী ব্যবসার জন্য ‘অনিরাপদ’ প্রমাণ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে ধ্বংস করা যাবে। সেটা করতে পারলে সেই ব্যবসার ভাগ পাকিস্তান পেতেও পারে, আর না পেলেও সেটাতে ভারতের অনেক ক্ষতি, তার তুলা ও অন্যান্য পোশাক শিল্প কাঁচামালের বাজার সে হারাবে।

যাদের মনে হচ্ছে এসব কথা কষ্টকল্পনা, তাদের শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধ এবং অনিরাপত্তা বাংলাদেশকে কিভাবে সুযোগ করে দিয়েছিল সেটা খুঁজে দেখতে বলব। বাংলাদেশ কিন্তু অনেক ভাবেই শ্রীলংকা হতে পারে।

১। শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের কারণে অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী তাদের ব্যবসা সরিয়ে নেয় এবং তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যা তৈরি পোশাক শিল্পের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল। (সূত্র: Kelegama, Saman. “Ready-Made Garment Industry in Sri Lanka: Facing the Global Challenge.” Institute of Policy Studies of Sri Lanka, 2009.)

২। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বাংলাদেশে জিএসপি (Generalized System of Preferences) সুবিধা থাকার কারণে অনেক পোশাক কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের উৎপাদন স্থানান্তরিত করে। (সূত্র: Rahman, Mustafizur, et al. “The Bangladesh Garment Industry and the Global Supply Chain: Governance, ‘Captive Market’ and Entrepreneurial Commitment.” South Asia Economic Journal, 2008.)

৩। বাংলাদেশে সস্তা শ্রম এবং শিথিল শ্রম আইন অনেক পোশাক উৎপাদনকারী সংস্থার জন্য আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, যা শ্রীলঙ্কার অস্থিরতার সময় তাদের বিনিয়োগের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। (সূত্র: Haider, Mohammed Ziaul. “Competitiveness of the Bangladesh Ready-made Garment Industry in Major International Markets.” Asia-Pacific Trade and Investment Review, 2007.)

একটা কথা ভুলে যাবেন না, সচিবালয়ে আনসার ঘটনাতেই প্রমাণ হয়েছে যে কোটা আন্দোলনকারীদের দুটো গ্রুপ। একটা মনে করে ৫ই আগস্ট দ্বিতীয় ৭১, আর একদল মনে করে ৫ই আগস্ট দ্বিতীয় ৭৫।

Related posts

ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী শেখ হাসিনা কীভাবে পুনরায় ফিরে আসতে পারেন

Ny Bangla

ফিলিস্তিনের বাস্তবতা শুধু মুসলমানদের নয়: ড. ইউনূস

Ny Bangla

আওয়ামী লীগ ছাড়া নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব না: জয়

Ny Bangla

মিথ্যা মামলায় আটক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে: রাষ্ট্রপতি

Ny Bangla

একাত্তর থেকে চব্বিশ; তাজা প্রাণ কেন যায় ?

Ny Bangla

চিন্ময়কৃষ্ণ দাশকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত চায় ইউনূস সরকার?

Ny Bangla

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Privacy & Cookies Policy