পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা সাশ্রয়ের তথ্য প্রকাশ হয় গত ৫ জুলাই। উপদেষ্টা ফাওজুল দাবি করেছেন, তার সরকারের কৃতিত্ব এটি। রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ২০২৭ সালে। উপদেষ্টা বলেছেন, এখানে কেন্দ্র হলেও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না।
এনওয়াই বিডি স্পেশাল
মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারকে আক্রমণ করছেন। কিন্তু তিনি যেসব দাবি করছেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। আওয়ামী লীগ সরকার আমলের কাজ তিনি নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করছেন এবং এটা থামছেই না।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ফাওজুল পদ্মা সেতু পরিদর্শন করে জাজিরা প্রান্তে সেতু কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে আসেন। দাবি করে বসেন, এই প্রকল্পে তার সরকার ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে।
অমনি ‘নতুন স্বাধীনতা পাওয়া’ সংবাদ মাধ্যমগুলো বড় বড় শিরোনাম করে বসল, অথচ তাদের পত্রিকাগুলোতেই যে গত ৪, ৫ ও ৬ জুলাই আওয়ামী লীগ সরকারের বরাত দিয়েই একই সংবাদ ছাপা হয়েছে, সেটি আর খুঁজে দেখার চেষ্টা করেনি।
ফাওজুল সরকারে আসার দেড় মাস আগে গত ৪ জুলাই পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম পদ্মা সেতু প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে এই টাকা সাশ্রয়ের কথা জানিয়েছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন “আমাদের সর্বশেষ বরাদ্দ থেকে এক হাজার ৮৩৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা কম খরচ হয়েছে। আমরা ওই টাকা নিয়ম অনুযায়ী সরকারি কোষাগারে জমা দেব।”
এই সংবাদটি ৫ জুলাই ছাপা হয় অনলাইন পত্রিকা ঢাকা পোস্টে, যার শিরোনাম ছিল পদ্মা সেতুর বরাদ্দ থেকে বাঁচল ১৮৩৫ কোটি টাকা।
কেবল ঢাকা পোস্ট না, সে সময় দেশের অনেক গণমাধ্যমই প্রতিবেদনটি ছেপেছে সে সময়।
অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সব কাজ গত ৩০ জুন শেষ হয়। ৫ জুলাই হয় সেতু প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠান।
সেই অনুষ্ঠানের আগের দিন জানানো হয়, এই প্রকল্পের সর্বশেষ বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। কিন্তু এক হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা সাশ্রয়ের ফলে শেষ পর্যন্ত খরচ হয় ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা।
কিন্তু প্রকল্প শেষ হওয়ারও প্রায় দুই মাস পর ফাওজুল উদ্ভট দাবি করে বসলেন। গত ১৬ আগস্ট তিনি উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন, যার ৪৭ দিন আগেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যায়।
সেই শপথ নেওয়ারও দুই সপ্তাহ পর আগের সরকারের কৃতিত্ব নিজের করে নেওয়ার চেষ্টা করে তিনি বলেন, ‘পদ্মার মূল সেতু নির্মাণে ৫৩০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। নদীশাসনের কাজে সাশ্রয় হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণে ১৭৮ কোটি টাকা বেঁচে গেছে। আরও যেসব খাতে টাকা সাশ্রয় হয়েছে, সেগুলো হলো মূল্যবৃদ্ধিজনিত বরাদ্দ (প্রাইস কন্টিজেন্সি) ৫০০ কোটি টাকা, ভূমি অধিগ্রহণ ১০৩ কোটি টাকা, পরামর্শক বাবদ ২০০ কোটি টাকা ও অন্যান্য ২৪৪ কোটি।’
এটুকু বলেই তিনি থামেননি। তার আরও কথা ছিল ‘যদি ভালো সরকার থাকত, তাহলে হয়ত আমরা পদ্মা সেতু অনেক কম ব্যয়ে নির্মাণ করতে পারতাম।’
এই সেতুর কাজে ফাওজুল ও তার সরকারের ন্যূনতম কৃতিত্ব নেই। কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সব ক্ষেত্রে ব্যয় কমানোর জন্য। আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়গুলোতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সব ক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়ে আনব। কাজ একই থাকবে, কিন্তু কম মূল্যে করব। এর ফলে একই টাকা দিয়ে আমরা বেশি পরিমাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারব। সেতু বিভাগের সচিবকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, পদ্মা সেতুতে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করতে। আমরা ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় সাশ্রয় করেছি।’
৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো ইউনূস সরকারের মুখপত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ফাওয়াজুলের এই উদ্ভট দাবির বিষয়ে কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করছে না।
তিনি এখানেই থেকে থাকেননি। পদ্মাসেতু পরিদর্শন করে এরপর যান খুলনার রূপসায়, সেখানে বিশাল একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু করে যায় আওয়ামী লীগ সরকার।
রূপসায় ৮০০ মেগাওয়াটের কম্বাইন্ড সার্কেল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ অবশ্য পরিকল্পনা অনুযায়ী আগায়নি, অন্য অনেক প্রকল্পের মত এটিও পিছিয়েছে নানা জটিলতায়।
এই কেন্দ্র পরিদর্শন করে উপদেষ্টা ফাওজুল বলেন, “এত দিন আমাদের দেশে একটি উন্নয়নের কাহিনি পড়ানো হচ্ছিল যে, বাংলাদেশে আমাদের মাথাপিছু আয় ও জিডিপি বাড়ছে। আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি। এখন দেখা যাচ্ছে এটা একটা ভ্রান্তি।”
নিজের উপলব্ধির বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “খুলনায় প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পাওয়ার প্ল্যান্ট হয়েছে, যা জাতীয় জিডিপিতে যুক্ত হয়েছে। জিডিপি বাড়লেও গ্যাসভিত্তিক এ পাওয়ার প্ল্যান্ট সহসা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
ফাওজুল নিশ্চয় বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে যাওয়ার আগে এর কিছুটা হলেও জেনে গেছেন। নিশ্চয় কর্মকর্তারা তাকে জানিয়েছেন এই কেন্দ্রটি ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে যাওয়ার কথা।
এই কথাটি তার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও সুন্দর করে লেখা আছে। এতে আরও লেখা এটির কাজ শেষ হয়েছে ৮২ শতাংশের মত।
অর্থাৎ ৮২ শতাংশ কাজ শেষ করার পর উপদেষ্টা ফাওজুল এখান থেকে বিদ্যুৎ চাইছেন।
এই কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় থরা হয়েছে ৮ হাজার ৪৯৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৫০ কোটি ডলার বা প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
২০১৮ সালের ২ আগস্ট শেরে বাংলানগরে বাংলাদেশ সরকার ও এডিবির মধ্যে ঋণচুক্তি সই হয়। এডিবির ঋণ ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৫ বছরে পরিশোধযোগ্য। ঋণের সুদহার ০ দশমিক ১০ শতাংশ।
প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা ছিল ভোলা থেকে গ্যাস এনে কেন্দ্রটি চালু করা হবে। পরে সেই পরিকল্পনা পাল্টানো হয়।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য গত ২৮ মার্চ সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিসিএল) সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটিতে গ্যাস সরবরাহ অ্যাগ্রিমেন্ট (জিএসএ) হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শীতকালে টেস্টিং-কমিশনিংয়ের জন্য এসজিসিএল গ্যাস সরবরাহ করবে। তবে ২০২৭ সালের জানুয়ারি থেকে বেইস লোডে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের কৃতিত্ব ছিনতাই করার চেষ্টায় ফাওজুল বলেন, ‘এখানে প্রয়োজন ১৪০ এমএমসিএফ গ্যাস কিন্তু ভোলাতে অতিরিক্ত আছে কেবল একশত এমএমসিএফ গ্যাস। তিন বছর সময় নিয়ে নতুন পাইপলাইন করে এ গ্যাস খুলনায় আনলেও সেটা পর্যাপ্ত হবে না। তবুও এ পাওয়ার প্ল্যান্টকে কীভাবে আংশিকভাবে সচল করা যায়, সে বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।’
তিনি কি ভেবেছেন এই কেন্দ্র নিয়ে কোথাও কিছু লেখা নেই?