প্রথম দিন থেকেই ছিল হিযবুত তাহরীর, এখন প্রকাশ করছে নিজেরাই। বিজিবিকে ছাত্রদলের কর্মীরা চার পাশ দিয়ে অ্যামবুশ করেছিল, টকশোতে এসে প্রকাশ। শিবির নিজেদের ব্যানার ছাড়া আন্দোলনে, সেটাও এখন বলছে নিজেরা।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তাতে হঠাৎ সহিংসতা, গোলাগুলি, পুলিশের ওপর বেপরোয়া হামলা শুরু হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে কী, তা একটু একটু করে প্রকাশ পাচ্ছে। এই গোমর ফাঁস করেছেন আন্দোলনে থাকা লোকেরাই।
উগ্রপন্থি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর, জামায়াত-শিবির, ছাত্রদল, হেফাজতে ইসলাম ও কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের পরিচয় আড়াল করে যে সংঘাত সহিংসতায় জড়িয়েছিল, তা স্বীকার করছে নিজেরাই। স্বীকার করেছে, ছাত্রদের ভুয়া আইডি কার্ড বানানো হয়েছিল।
প্রকাশ পেয়েছে ঢাকাকে ১৩টা সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল, বিজিবির ওপর অ্যামবুশ করা হয়েছিল, ছাত্রদের ভুয়া পরিচয়পত্র বানিয়ে আক্রমণ করা হয়েছিল। শক্তি প্রয়োগ করে বিজিবিকে আত্মসমর্পণ করানো হয়েছিল। একটি আধা সামরিক বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করাতে কী পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করতে হয় সেই প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
নিজেরাই তারা প্রকাশ করছে ব্যানার ছাড়া আন্দোলন করেছে, যেন এটি যে রাজনৈতিক কর্মীদের কাজ ছিল, তা বোঝা না যায়।
আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের করা সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের গুলির রহস্যও রয়ে গেছে। পুলিশ যেমন গুলি করেছে, তেমনি শুরুর দিকে লাশ ফেলে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টার বিষয়টিও আছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা তুলে দিয়ে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপনটা বাতিল করে হাই কোর্টের রায় কিন্তু সরকারের আপিলেই স্থগিত হয়ে যায়। অর্থাৎ যখন সরকারি চাকরিতে কোটা ছিল না, তখনই আন্দোলনটা দানা বাঁধে।
সরকার পতনের পর সমন্বয়কদের একজন আবু বাকের মজুমদার কিন্তু একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাদের সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির মূল লক্ষ্য ছিল সরকার পতন। তাদের টার্গেট ছিল ২০২৮ সাল। সেটি তারা এগিয়ে এনেছেন। তার দাবি, গত ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগানে মিছিল শুরু হওয়ার পরই তারা বুঝে গিয়েছিলেন সরকারের পতন হয়ে যাবে।’
পরিকল্পনা কতটা সুনিপুণ ছিল তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এখন বলছেন, তারা বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট শাটডাউন ইত্যাদি নামে আসলে হরতাল ও অবরোধ করেছেন। কিন্তু এই শব্দগুলো ব্যবহার করলে জনগণ ভুল বুঝতে পারত বলে তারা তা ব্যবহার করেননি।
পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠে ১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুর পর। এরপর ১৮ জুলাই ঘোষণা করা হয় কমপ্লিট শাটডাউন। সেদিন থেকেই মূল সংঘাত শুরু।
সেদিন কিন্তু প্রকাশ্যে ব্যানার নিয়ে মাঠে ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, যারা সাধারণত রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু রাজধানীর বাড্ডা ও উত্তরা এলাকায় পুলিশের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ আর গোলাগুলি শুরু হয়। বিভিন্ন সরকার স্থাপনায় গানপাউডার ঢেলে আগুন দেওয়া হতে থাকে। সেটি আর থামেনি। এর ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের।
সরকার পতনের ডাক এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে। কিন্তু ১৮ তারিখ থেকে সংঘাত সহিংসতায় কারা ছিল- সেই প্রশ্নটি এখন সামনে আনছে আওয়ামী লীগবিরোধীরাই। তারা বরং প্রশ্ন তুলছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কে ছিল? তাদের কে নিহত হচ্ছে এই প্রশ্নগুলো।
তারেক রহমানের পরিকল্পনা ও টাকায় বিজিবিকে অ্যামবুশ
এর মধ্যে বোমা ফটিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের একাংশের যুগ্ম সদস্য সচিব তারেক রহমান। ফেস দ্য পিপল নামে একটি ফেইসবুক ভিত্তিক পেজের অনলাইন টক শোতে এসে আন্দোলনে কী কী হয়েছে, সেটি তুলে ধরেছেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা সরকার পতনের আন্দোলনে আসলে কী করেছেন, সেই প্রশ্ন তুলে তিনি দাবি করেছেন, সবই করেছে বিএনপি, শিবির, হেফাজতপন্থি নেতাকর্মীরা।
তিনি জানান, যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরিকল্পনায় ঢাকাকে ১৩টি সেক্টরে ভাগ করে এই আন্দোলন হয়েছে। সে সময় আন্দোলনে ছাত্রদের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। পরবর্তীতে যে অধ্যায়টা শুরু হয়েছে, সেটা রাজনৈতিক কর্মীরা শুরু করেছে।
তারেক বলেন, ‘এই আন্দোলনে যদি আসিফ আর নাহিদ না থাকত, এই আন্দোলন জায়গায় গণেশ উল্টাত। আসিফ এবং নাহিদ যদি না থাকত, এই আন্দোলন আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।… টাকা পয়সা যা খরচ হয়েছে, ওখান থেকে দিয়েছে। আমাকে বলেছে, কত টাকা লাগবে। আমি বলেছি, এক বছরের রাজনৈতিক ব্যয় যা সব ঢেলে ফেলেন, শেখ হাসিনা মুক্ত হোক।’
গণঅধিকার পরিষদের নেতা বলেন, “ঢাকায় আন্দোলন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিকে ডাকছি, ‘তোমরা আস’, আসছে না, ইস্টওয়েস্টকে ডাকছি, তারা আসছে না। বলে, ‘আপনারা রাজনীতি করেন, আপনাদের সাথে আসব না’।
“তখন ভুয়া আইডিকার্ড বানিয়েছি ছাত্র হওয়ার জন্য। ছাত্র হয়ে রামপুরাতে আন্দোলন করেছি।”
ছাত্রদলের কর্মীদেরকে নিয়ে বিজিবির ওপর আক্রমণ করার কথাও ফাঁস করেছেন তারেক। তিনি বলেন, ‘আমাদের টার্গেট ছিল আমরা একটা বাহিনীকে অন্তত ঢাকাতে পরাজিত করব। একটা বাহিনীকে যদি আমরা পরাজিত করতে পারি, তাহলে সব বাহিনীকে পরাজিত করতে পারব।
‘সেই টার্গেট করে আমরা বিজিবিকে চার দিক থেকে অ্যামবুশ করেছিলাম। আটবার ট্রাই করে নবমবারে গিয়ে সফল হয়েছিল। বিজিবিকে আমরা আত্মসমর্পণ করিয়েছি। পরের দিন ১৩/১৪ জেলায় আমরা বিজিবিকে আত্মসমর্পণ করিয়েছি।’
গত ১৮ জুলাই বিটিভিতে হামলার ঘটনায় ২৩ জুলাই তারেককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সেদিন বাহিনীটি জানায়, তার নির্দেশ ও নেতৃত্বে তারা নাশকতা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
র্যাব সেদিন এও জানায়, তারেক মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারবিরোধী এক শ্রেণির প্রবাসীদের কাছ থেকে আন্দোলনের নামে অর্থ সংগ্রহ করতেন।
সেই তথ্যের সত্যতা এবার তিনি নিজেই প্রকাশ করলেন।
আমরাও ছিলাম: হিযবুত তাহরী
২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর নিষিদ্ধ ঘোষণা হলেও জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। তারা যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছে, নানাভাবে তা জানা যাচ্ছিল। এখন ১৮ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এভাবে মারমুখী হয়ে উঠার রহস্য ফাঁস করেছেন স্বয়ং হিযবুতের মিডিয়া সমন্বয়ক।
বিবিসি বাংলাকে তিনি প্রকাশ্যে এসেই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের পতনের পর তারা মিছিল সমাবেশ করছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ তাদেরকে কিছু বলছে না।
সেই মিডিয়া সমন্বয়কের নাম ইমতিয়াজ সেলিম। তিনিও শিবিরের মতই বলেছেন, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কর্মীরা সংগঠনের ব্যানার ছাড়াই মাঠে ছিল।
তার বক্তব্য ছিল এমন: “ইনক্লুডিং জেন-জি হিযবুত তাহ্রীর একটা ইন্টেলেকচুয়্যাল এবং পলিটিক্যাল লিডিং ফোর্স। ডেফিনিটলি আমরা মাঠে ছিলাম। কিন্তু এই আন্দোলনটা স্বতঃস্ফূর্ত যে গণঅভ্যুত্থান এটা কোনোভাবে যাতে কালার না হয় এবং কোনোভাবে যাতে এটাকে কেউ প্রভাবিত করতে না পারে আমরা খুবই সতর্কতার সাথে উইদাউট আওয়ার ব্যানার, আমরা মাঠে ছিলাম।”
সশস্ত্র পন্থায় জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী এই সংগঠনটি ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন তারা নিজস্ব ব্যানার নিয়ে নেমে পড়ে। এখন ‘সুসময়ে’ সরকার পতন আন্দোলনে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের বিষয়টিও এখন আর গোপন রাখছে না তারা। তারা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদনও করেছে।
ইমতিয়াজ সেলিমও বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি নর্থ সাউথ, ইস্টওয়েস্ট ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া কর্মীরা মাঠে ছিলেন।
১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে হঠাৎ করেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার কী কারণ, এই প্রশ্নের জবাব সম্ভবত এটিই।
সেদিন থেকেই ক্রমাগত গোলাগুলি শুরু হয়, যদিও পুরো দোষই গেছে পুলিশ ও সরকারের ওপর। সেদিন থেকে ১৯ দিনের ব্যবধানে সাড়ে ১৫ বছর শাসন করা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
পরিচয় গোপন করে নেতৃত্বে ছিল শিবির: বিবৃতি দিয়ে দাবি
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে উড়ে যাওয়ার পর ইসলামী ছাত্র শিবিরের একটি বিবৃতি আসে সংবাদ মাধ্যমে।
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বৈষম্যবিরোধী এই মহাযাত্রায় ছাত্রসমাজের প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে এতটুকুও কার্পণ্য করেনি। কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং এক দফা আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে ছাত্রশিবির নিজের ব্যানারকে, দলীয় প্রচারকে ও নিজস্ব ইমেজকে স্যাক্রিফাইস করে প্রতিটি আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে, ইনশাআল্লাহ।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘বিগত ১৬ বছরে ছাত্রশিবির নজিরবিহীন দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে এই জুলুমের অবসানের জন্য কাজ করেছে৷ কিন্তু এতদিন ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়নি। ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানে আপামর ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ এই জুলুমশাহীর পতন নিশ্চিত করেছে। সারাদেশে আপামর ছাত্র-জনতা যে অসাধারণ ত্যাগ স্বীকার করেছে, এই ত্যাগ আমাদেরকে উজ্জীবিত ও কৃতজ্ঞ করেছে।’
আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে ফুটব্রিজে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনায় হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। সাড়ে ১৭ বছর বয়সী এই কিশোরকে রিমান্ডে দেওয়ায় তীব্র সমালোচনা হয়। পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
মুক্তির পর ফাইয়াজ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তাকে শিবির অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি রাজনীতি করেননি।
তবে সরকার পতনের পর তার মিথ্যাচার ফাঁস করেছে শিবিরই। জামায়াত নেত শফিকুল ইসলাম মাসুদ নারায়ণগঞ্জে শিবিরের সাথী সমাবেশে ফাইয়াজকে মঞ্চে তুলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
ফাইয়াজ সেই সমাবেশে মুখে মাস্ক পরে যোগ দিয়েছিলেন। মাসুদ তাকে বলেন, ‘এখন আর মুখ ঢাকার দরকার নেই, এখন বুক খোলা রেখে চলার সময়’।