ফাহমিদা নীলা
৩১ অগাষ্ট, ২০২৪
আহারে সোনা বাচ্চাগুলা, না জানি কোন মায়ের সন্তান! মা হয়তো মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিতো। পকেট মানির জন্য হয়তো মায়ের পেছনে পেছনে ঘুরে ঘুরে টুকটাক ফান করে মাকে পটানোর চেষ্টা করতো। মোবাইল হাতে নিয়ে বিছানায় এলোমেলোভাবে ঘুমিয়ে গেলে, মা ধীরে ধীরে খুব সন্তর্পণে এসে হাত-পা ঠিক করে দিতো।
মাথার নীচে বালিশ রেখে, পাশে কোলবালিশে পা তুলে,গায়ে পাতলা চাদর টেনে দিয়ে লাইট নিভিয়ে যেতো। রাতে হঠাৎ মায়ের ঘুম ভেঙে গেলে অজানা আশঙ্কায় বাচ্চার ঘরে ঢুকে শুধু শুধুই আলতো করে বাচ্চার কপাল ছুঁয়ে দিতো, গায়ের চাদরটা ঠিক করে দিতো! আহারে সোনারা!
গত রাতে ভিডিওটি দেখার পর আর ঘুমাতে পারিনি। একটু চোখ চেপে আসলেই চমকে চমকে উঠেছি। হাত-পা কেমন হিম হয়ে এসেছে। একটু অসুস্থই ছিলাম, আমার অসুস্থতা যেন রাতারাতি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ছেলেটা এসে জিজ্ঞেস করল, ‘মা, তোমার হয়েছেটা কি?এমন করছো কেন?’ আমি কি করে বলি, আমার কি হয়েছে! কি করে বলি, আমি ‘মা সিনড্রোম’ নামক ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত রে বাবা। যে রোগে মানুষ বড় অসহায় হয়ে যায়। যে রোগে মানুষ শুধু কাঁদে।
শুধু শুধুই কাঁদে। অচেনা বাচ্চাটার হাত-পা ঠিক করে দেয়ার জন্য কাঁদে। অদেখা বাচ্চাটার কপাল ছুঁয়ে দেয়ার জন্য কাঁদে। অজানা গল্পটা পাল্টে দেয়ার জন্য কাঁদে। অদম্য বাচ্চাটার গায়ে চাদর তুলে আরামে ঘুমোতে দেয়ার জন্য কাঁদে। বাচ্চাগুলোকে ঠিকঠাক শুইয়ে দেয়ার জন্য কাঁদে। ঘুম যেন না ভাঙে এই চিন্তায় আস্তে লাইট নিভিয়ে অন্ধকার ঘরের বাইরে বসেও কাঁদে। এরা কেন কাঁদে, এরা নিজেও জানে না। এরা কেন অসহায়, এটা এই রোগে আক্রান্ত মানুষ ছাড়া তো কেউ বুঝবে নারে বাবা!
আহারে আমাদের টুনটুনি পাখিগুলা! ওদের গায়ে একটা ফুলের টোকাও পড়তে দেইনি আমরা। কোনদিন ওদের গায়ে হাত তোলেনি কেউ। এমন কি ওদের শিক্ষকেরাও না। এমন করে মারলে তোমরা? এমন করে ছুঁড়ে ফেললে? হাঁটতে শেখার পর থেকে ওরা একবার আছাড় খেয়ে পড়লে আমরা দশবার চেক করেছি, কোথাও লাগেনি তো বাবা! ঐ যে মাথাটা ঝুলে আছে ভ্যান থেকে! ঘাড়ে ব্যাথা পাবে তো! একটু ভালভাবে রাখতে পারতে না তোমরা?
আহারে সোনামণিগুলা! ‘গোসল কর, গোসল কর’ করে চিৎকার করে মা বিরক্ত হয়ে বসে পড়েছে কতবার! ওরা মোবাইলে মুখ গুঁজে ‘এই তো উঠছি মা’ বলে আবারও গেইম খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাচ্চাগুলোকে তোমরা শেষ গোসলটাও দিতে দিলা না?
আচ্ছা, ঐ পুলিশেরা তো সবাই পুরুষ ছিল, তাই না? তাদের ঘরে কি বাচ্চা ছিল না? আচ্ছা, নাই বা থাকলো বাচ্চা! আরেক বাচ্চা দেখে কি মনের ভেতরে ‘বাবা’ ‘বাবা’ অনুভূতি হয়নি কখনো? ‘মা’ সিনড্রোমের মতো বাবা সিন্ড্রোম’ বলে কি কোন রোগের অস্তিত্ব নাই পৃথিবীতে?
আহারে ময়না পাখিগুলা! মোনাজাতে যে তোমাদের মুখগুলোই বারবার ভেসে উঠছে বাবারা। সারাজীবন দোয়া করেছি, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’, এখন দোয়া করছি, ‘আমার সন্তান যেন থাকে প্রতিটি মায়ের মোনাজাতে’। ময়নারা, তোমরা মায়ের কোল জুড়ে থাকতে পারোনি, থাকতে দেয়নি ওরা। তোমরা বেহেশতের ফুল হয়ে ফুটে থাকো বাবারা। এই পাপের পৃথিবী পাড়ি দিয়ে কোনদিন যদি তোমাদের দেখা পাই, সেদিন ‘মা’ বলে ডেকো। আমার জান্নাতের পাখিরা!