ফেসবুকে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দাবি করা হচ্ছে আবদুল হামিদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আর সেলিনা হায়াৎ আইভীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করেছে আওয়ামী লীগ। এর সত্যতা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
সরকারের পতন হয়েছে, শেখ হাসিনা উড়ে গেছেন ভারতে। এরপর থেকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে ‘গনি মতের মাল’। দলের কার্যালয় গুলো, নেতাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান আর ব্যবসা লুট হয়ে গেছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেও সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগ সমর্থকদেরকে।
একের পর এক হত্যা মামলা, গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা লাপাত্তা, তাদের জন্য কোনো দিক নির্দেশনা নেই।
এর মধ্যে ফেসবুকে হঠাৎ করে দলের নেতৃত্ব পরিবর্তন নিয়ে একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে, দাবি করা হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে, সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।

এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে এই পোস্ট ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের সমর্থকরা অভিনন্দন জানাচ্ছেন, এটি ভালো কি মন্দ, তা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। কেউ কেউ অবশ্য সন্দিহান বিষয়টি নিয়ে।
আসলেই কি আওয়ামী লীগ এই বিষয়টি ভাবছে?
দলের শীর্ষ পর্যায়ের যেসব নেতারা দেশীয় বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কথা বলেছেন, তারা নেতৃত্বে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কাউকে আনার বিষয়ে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি। দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা সবাই এই পোস্টকে বানোয়াট বলেন।
একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, “এখন সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পাল্টানো, ভারপ্রাপ্ত করে দেয়া হচ্ছে, সামনে আরও কত গুজব শুনবেন। কিন্তু আমাদের নেতাকর্মীরা হামলা, মামলায় চরম বিপদের মধ্যে আছে। এখন তাদের মাঠে নামিয়ে বিপদ আরও বাড়াতে চাই না। সঠিক সময় বুঝে নেত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন।”
নেতারা বলেছেন, এখন দলের নেতাকর্মীদের জীবন রক্ষা হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রথম অগ্রাধিকার। তারা নিরাপদে থাকবে, দেশে বা দেশের বাইরে কোথায় থাকলে ঝামেলা হবে না, কাউকে কাউকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়লে কীভাবে সেটি করা যায়, তাও ভাবতে হচ্ছে।
এই অবস্থায় রাজনীতি করা বা দল গোছানোর সময় এখন আসেনি। বরং এটি করতে গেলে উল্টো কিছু নেতাকর্মী হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হবেন, গ্রেপ্তার হবেন বা তাদের প্রাণও যেতে পারে।
দেশের বাইরে চলে যেতে পারা একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, “অতি উৎসাহী কিছু লোকজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এগুলো ছড়িয়ে আওয়ামী লীগের আরও ক্ষতি করতে চাচ্ছে। এটা নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার জন্য নয়, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলার জন্য একটি চক্র এমন গুজব ছড়াচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আমরা এমনিতেই বিপদে আছি, এখন মাঠে নামার মত পরিস্থিতি আছে নাকি? এমন পরিস্থিতিতে কাউকে দায়িত্ব দিয়ে মাঠে নামাতে যাব কেন আমরা। তিনি নিজেও বিপদে পড়বেন, তার সঙ্গে থাকা লোকেরাও বিপদে পড়বেন।”
২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে টানা সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে একচেটিয়া কর্তৃত্ব রেখে চলছিল। তবে গত জুলাই থেকে আচমকা ঝড়ে কেবল ৩৬ দিনের আন্দোলনে তছনছ হয়ে যায় দলটির সাজানো বাগান।
সরকারি চাকরিতে কোটা তুলে দিয়ে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের রায়ের প্রতিবাদে জুলাইয়ের শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা মিছিল সমাবেশ করতে থাকে। সেই আন্দোলন ধীরে ধীরে সংঘাতময় হয়ে উঠে ১৮ জুলাই থেকে।
সেদিনকার কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে আচমকা ভেসে আসা গুলিতে কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। ফেসবুকে ছড়ানো ভিডিওতে এমনও দেখা গেছে, পুলিশ এক দিকে, কিন্তু অন্য দিক থেকে আসা গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন বিক্ষোভকারী।
এমন বেশ কিছু ঘটনার পর পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠে। পুলিশের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ হয়। প্রথমে রাবার বুলেট ব্যবহার করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি, পরে বুলেট ব্যবহার করে পুলিশ।
দিনভর সংঘর্ষের মধ্যে বিটিভি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, সেতু ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মেট্রোরেল স্টেশনসহ অসংখ্য সরকারি স্থাপনায় বেপরোয়া হামলা হয়, ফায়ার সার্ভিসকেও আসতে দেওয়া হয়নি।
এই সংঘাত ক্রমেই বাড়তে থাকে, ঢাকার যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর এলাকা হয়ে উঠে যুদ্ধক্ষেত্রের মত। একের পর এর মৃত্যুর মধ্যে হাজার হাজার মানুষও পুলিশের বিপক্ষে লড়াইয়ে নেমে পড়ে।
এর মধ্যে সরকার পতনের দাবিতে ৩ আগস্ট ডাক দেওয়া হয় অসহযোগ আন্দোলনের। দ্বিতীয় দিনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারত চলে যান।
সেদিন থেকেই আওয়ামী লীগের স্থাপনা ও নেতাকর্মীদের বাড়ি ঘরে বেপরোয়া হামলা ও লুটপাট শুরু হয়। লুটপাট থেকে বাদ যায়নি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনও। এই পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে থাকা সমীচীন মনে করেননি দলের নেতা-কর্মীরা।
ভারতে অবস্থানকারী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে কেবল যথাযোগ্য মর্যাদায় ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী পালনের নির্দেশনা আসে। কিন্তু প্রবল বাধার মুখে সেটাও পালন করা যায়নি।
এর মধ্যে ফেসবুকে দলের ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্ব নিয়ে পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের সেই নেতা বলেন, “যারা এসব কথা ছড়াচ্ছে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী? দলের কোনো দায়িত্বশীল কেউ কি এটা বলেছে? কৌশলে কেউ কেউ এমনটা ছড়াচ্ছে আর আমাদের কিছু অতি উৎসাহী সমর্থকরা সেটা ফেসবুকে দিচ্ছে, এর কোনো ভিত্তি নাই।”
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেন, “বর্তমানে যে খারাপ পরিস্থিতি এসেছে, তা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় সে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হচ্ছে, এটা সত্য। কোনো নেতাদের সংগঠন গোছানোর কাজে লাগানো যায়, তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। তবে কাউকে দায়িত্ব দিয়ে বা সভাপতি- সম্পাদক করে করতে হবে এমনটি নয়। ফেইসবুকে যা দেখছেন, এগুলো ভুয়া।”
একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেছেন, “জরুরি অবস্থার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এভাবে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল। সেই চেষ্টা এবারও হচ্ছে। নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করতে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে।”
শিগগিরই দল কোনো সাংগঠনিক কর্মসূচিতে যাচ্ছে না নিশ্চিত করে তিনি বলেন, “আপাতত চুপ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। দলের নেতাকর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশনা এত তাড়াতাড়ি না।”