New York Bangla Life
বাংলাদেশবিশেষ প্রতিবেদন

আসল ফ্যাসিবাদের কবলে বাংলাদেশ!

যারা ক্ষমতায় ও ক্ষমতা বলয়ে তারা যা খুশি তাই করছে। এমনকি অফিসে সিগারেটের প্যাকেট পাওয়ার পর এক সরকারি কর্মকর্তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।


বাংলাদেশে ‘ফ্যাসিবাদ’ বলে প্রথম আক্রমণটা শুরু হয় ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়, যে সময় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে মাঠে নামে গণজাগরণ মঞ্চ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার পর বিশাল বিশাল সমাবেশ হচ্ছিল তার ফাঁসির দাবিতে। কিন্তু সেসব সমাবেশ থেকে কেউ মানুষের গায়ে একটি ফুলের টোকাও দেয়নি।

সে সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ ছিল না সরকারের। পরে জনতার চাপে সেই সুযোগ তৈরি করে আওয়ামী লীগ। সংসদে সংশোধন হয় আইন।

এই বিক্ষোভকে ‘ফ্যাসিবাদের উত্থান’ বলে শিরোনাম করে আমার দেশ পত্রিকা। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্রমাগত ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছে বিএনপি-জামায়াতসহ টানা সাড়ে ১৫ বছর বিরোধী দলে থাকা দলগুলো।

গত ৩ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের যে এক দফা দাবি তোলা হয়, সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করতে চায়।

৫ আগস্ট সরকারের পতন হলো, এরপর কী দেখা যাচ্ছে? আওয়ামী লীগ সরকারের সদস্য কেবল না, দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেল গনিমতের মাল। বিএনপি-জামায়াত আর আন্দোলনকারীরা বিজয়ীর বেশে সব লুটে নিয়ে যাচ্ছে এরপর পোড়ামাটির নীতি অবলম্বন করে ধরিয়ে দিচ্ছে আগুন।

আগুন লাগাতে গিয়ে লালমনিরহাটে জামায়াত নেতার ছেলে, বিএনপি নেতার ছেলেসহ মারা গেছে ৬ জন, নাটোরে জামায়াত নেতার ছেলেসহ মারা গেছে ৪ জন, যশোরে একটি বহুতল আবাসিক হোটেলে আগুন দিয়ে হত্যা করা হয়েছে ২৪ জনকে। রংপুরের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, সড়কে ফেলে কয়েকজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে উল্লাস করতে করতে।

আন্দোলনের সময় পুলিশ মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে সন্দেহ নেই, এসব ঘটনায় দায়ীদের বিচার করতে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা না, সেই দাবি কেউ করছেও না। কিন্তু সরকার পতনের আগের দিন থেকে পিটিয়ে কুপিয়ে আগুন দিয়ে যে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে, সেসব নিয়ে কোনো কথাই কিন্তু নেই।

অথচ ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার পরে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। সরকারি হিসাবে পুলিশের নিহতের সংখ্যা বলা হচ্ছে ৪৪ জন, কিন্তু পুলিশেরই তথ্য বলছে সেটি কয়েকশ, কিন্তু তা প্রকাশ করা হচ্ছে না।

আর লুটপাট তো চলছে বেশুমার। গাজী গ্রুপের কারখানার পারলে দেয়ালও লুট করে নিত মনে হয়, এ ছাড়া যা যা খোলা যায়, তার সবই খুলে নিয়ে গেছে, গ্রুপটির কর্মীদের হিসাব বলছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ লুট হয়েছে। আর উৎপাদন বন্ধ, ব্যবসার ক্ষতি, মার্কেটে থাকা মাল, ইত্যাদি হিসাব করলে সেটি কয়েক হাজার কোটি টাকা হবে।

কেবল গণভবন বা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি নয়, আনাচে কানাচে বিপণি বিতান, দোকান, বাড়িঘর লুট ধরলে বাংলাদেশের কয়টি বাজেটের টাকা এই কয়দিনে লোপাট হয়েছে, সেই হিসাব এই সরকার অন্তত করবে না।

এত বড় বড় ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু এর কোনো কিছুই কি বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে আসছে? উত্তর হল ‘না’। অথচ ফেসবুকে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেগুলো ধরেও প্রতিবেদন তৈরির সাহস করছে না কেউ। উল্টো রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আজগুবি অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যস্ত তারা।

এই যে প্রতিবেদন করার মত সাহস কি আসলে সাংবাদিকদের আছে? সরকার পতনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগপন্থি একাত্তর টিভি। আক্রমণ হয়েছে ডিবিসি চ্যানেলে।

সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনেও আক্রমণ হয়েছিল, সেখানকার এক বিএনপিপন্থি সাংবাদিক সেটি ঠেকিয়েছেন দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে। বলেছেন, এই টিভি এখন তারাই চালাবেন। এরপর হামলাকারীরা সরে যায়।

সংবাদ মাধ্যমের রাজনৈতিক পক্ষপাত সারা দুনিয়াতেই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আইনি পথে সংবাদ মাধ্যম বন্ধ হওয়ার নজিরও আছে বাংলাদেশেও। সেটি বিএনপি আমলেও হয়েছে, আওয়ামী লীগ আমলেও হয়েছে।

কিন্তু সেই পথে না গিয়ে হামলা-হুমকি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘আমাদের বয়ানের বাইরে কোনো কিছু চলবে না।’ আর সেদিন থেকেই বাংলাদেশের প্রায় সব মিডিয়ার বয়ানও পাল্টে গেল।

কেবল সংবাদ মাধ্যমের বয়ান না, আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন, তারা এমন ব্যবস্থা করতে চান, যেখানে তাদের বিরুদ্ধেও কথা বলা যাবে। কিন্তু সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনই সরকার পতনের ৫ দিনের মাথায় তাদের ভাষায় ‘দালাল সাংবাদিক’ এর তালিকা প্রকাশ করে বলেছে, এর এর চাকরি থাকা চলবে না।

তাদের বয়ানের বিরুদ্ধে কথাকে ‘মিথ্যাচার’ উল্লেখ করে ৪৯ জনের নাম প্রকাশ করে লেখা হয়, “আমরা মনে করি সাংবাদিকতার আড়ালে এদের কর্মকাণ্ড ছিল জাতীয় স্বার্থ ও রাষ্ট্রবিরোধী। ছাত্ররা এখন রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। এসব জাতীয় দুশমনরা প্রেসক্লাবের বা সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে আর যাতে জাতির ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য তাদের বহিষ্কার ও সাংবাদিকদের অঙ্গনে নিষিদ্ধ করার নিবেদন জানাচ্ছি।”

সেই তালিকার বেশ কয়েকজন এরই মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন, সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে অনেকে অনেক সুবিধা নিয়েছেন সত্য, তবে এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা পেশাদার সাংবাদিক, সাংবাদিকতাকে তাদের আর্থিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন না।

বহু মত পথের বাংলাদেশে সবাইকে কেন একভাবে চিন্তা করতে হবে, এই বিষয়টি কেবল সরকারের বাইরে থাকলেই বলা যায়। কিন্তু যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ হওয়ার দশা।

সেই তালিকা প্রকাশের ১০ দিনের মাথায় আরও একটি তালিকা প্রকাশ হলো। মজার বিষয় হলো, গত সাড়ে ১৫ বছরে সরকারের সমালোচনায় মুখর ও আওয়ামী লীগবিরোধী জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সাংবাদিকরাও এই তালিকা থেকে বাদ যায়নি। মনে হচ্ছে ভবিষ্যতেও তারা সমালোচনা করতে পারেন, এই ভয়েই আগেভাগেই তাদেরকে ছেঁটে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

২৩৫ জন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে এই তালিকায় লেখা হয়, “যে সমস্ত তথাকথিত সাংবাদিক ফ্যাসিস্ট সরকারের দালালি, গণতন্ত্র এবং দেশবিরোধী কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে, অন্য একটি দেশের পক্ষে কাজ করেছে, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থসম্পদের মালিক হয়েছে, শেখ হাসিনার কাছ থেকে প্লট এবং পদপদবি নিয়েছে, নির্বাচনি কারচুপিতে সহযোগিতা কিংবা সমর্থন দিয়েছে, হাসিনার তল্পিবাহক প্রশাসন এবং গোয়েন্দাদের পদলেহন করেছে এবং সর্বশেষ ছাত্র-গণমানুষের আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে ও গণহত্যাকে সমর্থন করেছে, তাদেরকে সাংবাদিকতা পেশায় নিষিদ্ধ করা এবং বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো উচিত।”

ভাষাটা লক্ষণীয়, আইনের বিরুদ্ধে না গেলে যে কোনো আন্দোলন বা দাবির বিরোধিতা বা পক্ষে যাওয়ার অধিকার কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে অস্বীকার করা হয়নি। সরকার পতনের আন্দোলনের পক্ষে থাকার অধিকার যেমন মানুষের থাকার কথা, তেমনি বিরোধিতার অধিকারও থাকা উচিত।

এই তালিকায় যে নাম আছে, তাতে কিন্তু বাদ যাননি আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে ডয়েচেভেলেতে টক শোর উপস্থাপক মুহাম্মদ খালেদ মুহিউদ্দিনও।
প্রথম আলো পত্রিকায় আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর সোহরাব হোসেন, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, এখন সাংবাদিকতায় না থাকা শরীফুজ্জামান পিন্টু, চ্যানেল আইয়ের শাইখ সিরাজ, সমকাল সম্পাদক আলমগীর হোসেন, বিএনপিপন্থি সাংবাদিক ইলিয়াস খান এমনকি রাজনীতি নিয়ে মাথাও না ঘামানো আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এপির জুলহাস আলমের নামও আছে এতে।
আওয়ামী লীগ সরকারের বয়ানের বিরোধিতা করা বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, পাভেল রহমান, সাইফুল ইসলাম কল্লোলদেরও সাংবাদিকতায় রাখা যাবে না, এমন আবদার তোলা হচ্ছে।

প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে যারা আওয়ামী লীগ বিটে কাজ করেছে, তাদের সবার নামও আছে এই তালিকায়। এমনকি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা শওকত মাহমুদের নামও বাদ যায়নি।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উপদেষ্টা পরিষদে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া নাহিদ ইসলাম বলে যাচ্ছেন স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য কমিশন করবেন তারা। কিন্তু সেটি কোন ধরনের স্বাধীন গণমাধ্যম হবে, তার নমুনা তো দেখাই যাচ্ছে।

আর কথিত স্বাধীনতা পেয়ে এখন আন্দোলনের বিজয়ী পক্ষ যা করছে, তা বলার না। সরকার থেকে একে বাধ্যতামূলক অবসরে দেওয়া হচ্ছে, তাকে ডাবল, ত্রিপল প্রমোশন দিয়ে বড় পদে বসানো হচ্ছে, অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা এই অফিসে গিয়ে একে পদত্যাগ করাচ্ছে, ওই অফিসে গিয়ে তাকে পেটাচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা শিক্ষকদের অপমান করে পদত্যাগ করাচ্ছে, শিক্ষকদেরকে কক্ষে আটকে রাখতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেটি ভয়াবহ।
পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী তৌফিকুল ইসলামের কক্ষে গিয়ে তল্লাশি করে তার টেবিলের ড্রয়ারে দুটি সিগারেটের প্যাকেট পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে একদল তরুণ। স্লোগান উঠে মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার।

সিগারেটের প্যাকেট দুটি তৌফিকুলের শার্টের কলারে দুই দিক দিয়ে স্ট্যাপলড করে আটকে দেওয় হয়, এর আগে তাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়।

তৌফিকুল ভয়ে সত্যি সত্যি কাঁপতে থাকেন। তিনি হার্ট অ্যাটাক করে ফেলেন কি না, এমন পরিস্থিতিও তৈরি হয়। তবে সেই তরুণরাই তাকে পানি পান করান। এখন তিনি হাসপাতালে আছেন।

এই যে এসব ঘটনা ঘটছে, তা নিয়ে কোনো বিকার নেই সরকারে। তারা আছে চাকরি খাওয়া একে বাদ দিয়ে তাকে বসানো।


Related posts

রাষ্ট্রপতি পদে থাকা বা না থাকা সাংবিধানিক নয়: নাহিদ ইসলাম

Ny Bangla

পুলিশ হেফাজতে ববি সমন্বয়ক শুভসহ ১২ শিক্ষার্থী

Ny Bangla

সাড়ে ১৫ বছরের বৈষম্য থেকে মুক্তি পেয়েছে দেশের মানুষ: জামায়াত আমির

Ny Bangla

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান ড. ইউনূসের

Ny Bangla

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটদের পদত্যাগ

Ny Bangla

প্রশ্নপত্র  ফাঁসকারীদের শাস্তির আওতায় আনবেন বাংলাদেশ সরকার

Ny Bangla

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Privacy & Cookies Policy