সিরাজুল হোসেন, লেখক
কোভিডের বিশ্ববিপর্যয় শেষ হতে না হতেই আজ আর একটি দেশের মহা বিপর্যয় দেখছে বিশ্ব। ২০০৮ সাল থেকে রাশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার জন্য ইউক্রেনের একনায়ক সরকারকে ক্রমেই নানা উৎকোচ উৎসাহ ও সমারিক সাহায্য দিয়ে গেছে আমেরিকা এবং ন্যাটো। ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হলে ইউক্রেনে বসবে ন্যাটো ও আমেরিকার সামরিক ঘাটি।
সেখানে স্থাপিত হবে ন্যাটো ও আমেরিকার পারমানবিক অস্ত্র এবং ক্রুজ মিসাইল। ন্যাটো জোটের মস্কোতে আক্রমণ তখন একটি বোতাম চাপার ব্যাপার মাত্র যেহেতু ইউক্রেন থেকে মস্কোতে আঘাত হানতে সময় লাগবে খুবই কম। কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেবার সময় পাবে না মস্কো।
বিষয়টা অনেকটা মেক্সিকো যদি ওয়ারশ জোটভুক্ত হয়ে সোভিয়েত ব্লকে চলে যেত সেরকম। আমেরিকার নিকটবর্তী কিউবা যেমন ওয়ারশ জোটভুক্ত হবার পর শুরু হয়েছিল ঠান্ডা যুদ্ধ শুধু নয়, একাধিকবার প্রায় শুরু হতে যাচ্ছিল নিউক্লিয়ার আর্মাগাডন বা পারমানবিক চূড়ান্ত যুদ্ধ।
সেই হিসাবে রাশিয়ার জন্য ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়া তাদের জীবন মরণের সমস্যা। এটা যাতে না হয় তার জন্য রাশিয়া বিশ্বযুদ্ধ বাধাতেও দ্বিধা করবে না। সুতরাং ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার চেষ্টা মানেই যে রাশিয়াকে যুদ্ধে ঠেলে দেওয়া এটা সবার কাছেই পরিষ্কার ছিল। সুতরাং সেই যুদ্ধ যাতে শুরু না হয় সেই চেষ্টাই সবার করা প্রয়োজন ছিল।
সেই যুদ্ধ সত্য সত্যই শুরু হয়ে গেলে সবার উচিত ছিল দ্রুত আলোচনার ব্যবস্থা করে ইউক্রেনকে রক্ষা করা এবং রাশিয়াকে আশ্বস্ত করা। বিষয়টি রাশিয়ার জন্য জীবন মরণ সমস্যা কিন্তু ইউক্রেনের জন্য তো নয়। তাদের এখনই এই বিপদ ডেকে আনার কি প্রয়োজন ছিল?
পেরেস্ত্রোইকা বা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যখন ইউক্রেন স্বাধীন হয় তখন রাশিয়ার সাথে ন্যাটো জোট ও ইউক্রেনের এই শর্তেই সেটা হয় যে ইউক্রেন কখনও ন্যাটোজোটভুক্ত হবে না, তারা তাদের কাছে থাকা সোভিয়েত পারমানবিক অস্ত্র ধ্বংস করবে, তারা পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে এবং বিনিময়ে রাশিয়া তাদের বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা দেবে।
এসব শর্ত মেনেই ইউক্রেন স্বাধীন হয় যেগুলোকে মিলে তৈরি হয় মিনস্ক প্রটোকল (মিনস্ক-১ চুক্তি) যার একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল ইউক্রেন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী রুশপন্থী অঞ্চলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা।
কিন্তু ইরাক আফগানিস্তানে ব্যর্থ হবার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০৮ সালে হঠাৎ করেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত হবার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ঐ সময় ইউরোপিয় ইউনিয়নের অনেক দেশ বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানি এর বিরোধিতা করে কারণ এটা রাশিয়ার সাথে তাদের শর্ত ভঙ্গ করে (মিনস্ক-১ চুক্তি) এবং এটা আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিনষ্ট করবে।
কিন্তু এই বিরোধিতায় কোন কাজ হয়নি। আমেরিকা ইউক্রেনকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করে যেতে থাকে এবং সিআইএ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে ইউক্রেন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী রুশপন্থী অঞ্চলের মধ্যে বিরোধ জোরদার করার জন্য।
শুধু এটুকুই নয়, ইউক্রেনের রাজনীতিরও ক্রমেই আমেরিকাকরণ হয়। পপুলিস্ট অলিগ্রার্কিক চরম ডানপন্থি উত্থান ঘটতে থাকে সেখানে। যারা বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাদের কর্মীদের জেলে পুরেছে, যারা তাদের সমালোচনা করেছে সেইসব টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে ।
বুশের পর ওবামা আসলেও আমেরিকার ইউক্রেন নীতির কোন পরিবর্তন হয় না। ক্রমেই আমেরিকা ও ইউক্রেন সরকারের মিনস্ক প্রটোকল অমান্যের কারণে ইউক্রেনে রুশভাষী ও ইউক্রেনিয়দের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বৃদ্ধি পায় এবং আভ্যন্তরীণ দমন নিপীড়ন ও সংঘাত বৃদ্ধি পায়। এর ফলেই ২০১৪ সালে মিনস্ক-২ চুক্তিপত্র তৈরী হয় এবং ২০১৫ সালে বেলরুশ, রাশিয়া, জার্মানী ও ফ্রান্সের নেতাদের উপস্থিতিতে মিনস্ক-২ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও ইউক্রেন বা আমেরিকার আচরণের কোন পরিবর্তন হয় না। তারা মিনস্ক ১ ও-২ চুক্তির কোন তোয়াক্কাই করে না এবং সিআইএ পূর্ন উদ্যমে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে।
আমেরিকায় ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে হোয়াইট হাউজের উদ্দোগে কিছুটা ভাটা পড়ে কিন্তু সিআইএ ভেতরে ভেতরে তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু এর মধ্যে ইউক্রেনে পপুলিস্ট রাজনৈতিক কৌশলে কৌতুক অভিনেতা ভালদিমার জেলেনিস্কি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যায়।
আমেরিকায় বাইডেন নির্বাচিত হয়ে আসলে বুশ-ওবামা পররাষ্ট্রনীতি – মুখে গণতন্ত্র আর মনে দখল – এই ফাঁদে আবার পড়ে ইউক্রেন। বাইডেনের প্ররোচনায় আবার ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হবার তোড়জোড় শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতেই রাশিয়া সামরিক আক্রমণ শুরু করে ইউক্রেনে।
সেই কারণে ২০১৪ সাল থেকেই তারা এর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে, তাদের সমর কৌশল নির্ধারণ করেছে এমনকি অর্থনীতিতে পশ্চিম নির্ভরতা তথা আমেরিকান ডলারের উপর বানিজ্য মাত্র বিশভাগে নামিয়ে এসেছে।
আমি নিশ্চিত একটি বিশ্বযুদ্ধ মোকাবেলায় তারা অন্য যে কোন দেশের চাইতে বেশি এগিয়ে। ঠিক যেমন এগিয়ে ইরান, উত্তর কোরিয়া বা অন্য বিশ্ব অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন দেশগুলো।
পশ্চিমা বিশ্বের শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর একটি ভুল ও অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ এমন কিছু সমীকরণ তৈরি করবে যার ফলে পরে আর যত চেষ্টাই করা হোক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেইন রিঅ্যাকশন আর থামানো যাবে না।