New York Bangla Life
বাংলাদেশবিশেষ প্রতিবেদন

ইউনূসের ‘আসল উদ্দেশ্য’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে কী বোঝাতে চাইলেন ফখরুল?

ইউনূসের কাছে প্রথমবারের মত ভদ্র ভাষায় জবাবদিহিতা চাইল। নির্বাচনের রোডম্যাপ চাইলেন মির্জা ফখরুল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে কিনা, সেই জবাব দেবে ভবিষ্যৎ।


শত্রুর শত্রু বন্ধু হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর বিএনপি এক সমান্তরালে ছিল গত ১৫টি বছর। আওয়ামী লীগ সরকার পতন আন্দোলনে বাম, ডান, দেওবন্দি, জামায়াত, হিযবুত তাহরীরের মত উগ্রবাদী সবাই ছিল সক্রিয়। রাজনীতির খেলাটা বুঝতে না পেরে আবেগে জড়িয়েছে সাধারণ মানুষও।

কিন্তু ৫ আগস্ট কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়নি, দেশের পুলিশি ব্যবস্থা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে, এর সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন, রাজনীতি সব জায়গাতেই শূন্যরা। যেটুকু বাকি ছিল সেটাও ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রশাসনে রদবদল, একে রেখে তাকে বসাও নীতি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে বাকি যা কিছু ছিল, তাও শেখ করেছে।

আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে নেই, হানিমুন পিরিয়ড পার করে বিএনপি দেখতে পাচ্ছে, দিন যত আসছে, ক্ষমতা তাদের কাছ থেকে তত দূরে সরে যাচ্ছে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মরিয়া হয়ে ড. ইউনূসের কাছ থেকে তার কর্ম পরিকল্পনা চাইলেন।

কিন্তু ড. ইউনূস যে ফখরুলদের কাছে কর্ম পরিকল্পনা দেওয়ার জন্য আসেননি, সেটি তার মত পোড় খাওয়া রাজনীতিকের আসলে না বোঝার কথা না।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে বা না করে ভারত চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মির্জা ফখরুল তার সাবেক জোটবন্ধু নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামী আর বামপন্থী জোনায়েদ সাকীদেরকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের কাছে।

সেই আলোচনা শেষে সেনাপ্রধান জানালেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার হবে এবং তারা এ নিয়ে আলোচনা করতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে যাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগ না থাকলে ক্ষমতা তাদের হাতেই আসবে, ধরে নিয়ে ফুরফুরে বিএনপি গেল বঙ্গভবনে। সেখানে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে এসে মির্জা ফখরুল বঙ্গভবনের ফটকে সাংবাদিকদেরকে বললেন, “এর মধ্যে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা হচ্ছে প্রথমত, আজকেই পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে তারা অচিরেই একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন এবং সেই সরকার তিন মাসের মধ্যেই নির্বাচন করবে।”

তিনি এও বললেন, রাষ্ট্রপতি জাতির ‍উদ্দেশে ভাষণ দেবেন এবং এ বিষয়ে কথা বলবেন।
রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন, ফখরুলের ভাষ্যের সবটুকু বললেন না, নির্বাচনের কথাটি উহ্য রাখলেন।

সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার বলতে কোনো বিধান নেই। বলা আছে সংসদ ভেঙে দিলে পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি দেশেই নেই, এই অবস্থায় রাষ্ট্রপতির অন্তর্নিহিত ক্ষমতাবলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ছাড়া বিকল্পও ছিল না।

সেই সরকারের প্রধান কে হবেন, বিএনপি সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করতে না করতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফে নাম ঘোষণা হল ড. ইউনূসের, যাকে আসলে একটি সুনিপুণ পরিকল্পনা তৈরি করে ২০০৭ সালেই ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা হয়েছিল।

সেই চেষ্টা সেবার সফল হয়নি, তবে এবার আর পথের কোনো কাটা ছিল না। তিনি উড়ে এলেন ফ্রান্স থেকে। ৮ অগাস্ট শপথ হল। তার উপদেষ্টা পরিষদের তালিকা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তারা আর যাই হোক ৯০ দিনের মধ্যে সরে যেতে ক্ষমতায় বসেননি।

সেদিন থেকেই সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে লাগলেন, ক্ষমতায় কত দিন থাকবে এই সরকার। উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়া সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সুমধুর গলায় ধমকে দিয়ে বললেন, ‘কড়া প্রশ্ন করবেন না।’

এরপর থেকে যতবার এই প্রশ্ন এসেছে, ততবার বলা হয়েছে, রাষ্ট্র সংস্কারের কথা। বিএনপি কিছু বুঝতে পেরেছে কিনা, তা বোঝা যায়, তবে নির্বাচনের দাবি প্রথম কিন্তু তুলেছিলেন ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ হয়। তিনি জোরাল কণ্ঠেই বলেছিলেন, ভোট দিতে হবে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী ৯০ দিনেই।

তার সেই বক্তব্য নিয়ে হাসাহাসি হয়েছে, বিএনপি ১২ আগস্ট ইউনূসের সঙ্গে মত বিনিময়ে গেছে, সেই আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ১৫ আগস্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর দিনটি যে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে, সেই দিনটিতে কী হবে।

বিএনপি, জামায়াত ও তার সঙ্গে থাকা নেতারা কী প্রস্তাব দেবেন, তা অজানা ছিল না কারও। পরের দিন রাজনৈতিক দলগুলোর কথিত ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ইউনূস সরকারের সিদ্ধান্ত আসে, ১৫ আগস্টের শোক দিবসের ছুটি বাতিল।

বিএনপি বাকবাকুম, তবে মির্জা ফখরুলের রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় কিছু বিষয় নিশ্চয়ই ধরা পড়েছিল। নইলে সেদিন তিনি নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে কেন ইউনূস সরকারকে পরোক্ষ ভাষায় হুমকি দেবেন?

সেদিন তিনি বলেছিলেন, “এটা ছাত্র-জনতার সরকার, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল। আমরা তাদেরকে সহযোগিতা দেব যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা গণতন্ত্রের পক্ষে থাকবে, গণতান্ত্রিকভাবে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।”

অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর থেকে বিএনপির সমর্থন তুলে দেবে, সে কথা আগেভাগেই জানিয়ে দিলেন।

তিন দিনের মধ্যে ফখরুলের চিন্তা ভাবনায় কেন পরিবর্তন এসেছে, সেটি জানা বোঝা মুশকিল, কারণ তিনি এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছুই বলছেন না। অথচ ১২ আগস্ট ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসে এই ফখরুলই বলেছিলেন, “আজকে নির্বাচন নিয়ে আমরা কথা বলিনি। আমরা আগেও বলেছি আপনারা জানেন যে, একটা নির্দিষ্ট সময় লাগবে নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে। আমরা তাদেরকে সেই সময়টি আমরা অবশ্যই দিয়েছি। আমরা তাদের সব বিষয়গুলোতে সমর্থন দিয়েছি।”

ইউনূস সরকার যে ৯০ দিন বা সংবিধানে উল্লেখ থাকা দৈব দুর্বিপাকের কথা বলে আরও ৯০ দিন ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন দেওয়ার জন্য বসে নেই, সেই ইঙ্গিত আরও মিলেছে।
ফখরুল প্রথমবারের মতো হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরদিন শপথ নিলেন আরও চার জন উপদেষ্টা, উপদেষ্টা মর্যাদায় এক বিশেষ সহকারীও দায়িত্ব পেয়েছেন।

বিএনপি নেতাকে অ্যাটর্নি জেনারেল করা, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি করা, আইজিপি, ঢাকার পুলিশ কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে বিএনপির পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়ায় দলটি ছিল ফুরফুরে। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড দেখে ফখরুল প্রমাদ গুনছেন।

ইউনূস সরকার নিয়ে যে বিএনপি মহাসচিবের সন্দেহ দানা বেঁধেছে তা এবার তিনি স্পষ্টতই প্রকাশ করলেন। এই সরকার আসলে কী করতে চায়, সে প্রশ্ন তুলছেন প্রকাশ্যেই।
ফখরুল বললেন, ‘‘আমরা বিশ্বাস করি, যারা অন্তর্বর্তী সরকারে কাজ করছেন তারা সবাই আন্তরিক, যোগ্য মানুষ। কিন্তু আমরা এটাকে আরও আরও দৃশ্যমান দেখতে চাই।

‘‘আমরা দেখতে চাই যে, প্রধান উপদেষ্টা তিনি অতি দ্রুত জনগণের সামনে তিনি কী করতে চান তা উপস্থাপন করবেন। একটা রোডম্যাপ দেবেন যে, কীভাবে তিনি অতি দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন, কীভাবে তিনি প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো ঘটিয়ে তারা জনগণকে স্বস্তি দিয়ে সামনের দিকে এগুবেন নির্বাচন করার জন্য।”

অর্থাৎ প্রথমবারের মত ইউনূসের কাছে জবাবদিহিতা চাইল বিএনপি, এত বছর তার পক্ষে কথা বলে এসে হঠাৎ ইউটার্নের সময় ভাষাটা কেবল সংযত রেখেছেন ফখরুল।
বিএনপি নেতা শনিবার ঢাকায় যে-সব বক্তব্য রেখেছেন, তার অনেকগুলোই ইউনূসের প্রতি সন্দেহ সংশয়ে ভরা। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন সংস্কার নিয়েও।

উপদেষ্টারা প্রথম দিন থেকেই সংস্কারের কথা বলছেন। সেই সংস্কারের পদক্ষেপ হিসেবে প্রশাসন ও পুলিশে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর, বদলি, ‘বঞ্চিতদের’ ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দেওয়া, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের বিষয়টি সামনে আসছে।

কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিয়ে এখনও কোনো পদক্ষেপ নেই সরকারের, অথচ সংস্কারের ক্ষেত্রে এটা থাকা উচিত ছিল অগ্রাধিকার তালিকায়। আবার বেশ কিছু পদে এমন লোকদেরকে বসানো হয়েছে যারা আওয়ামী লীগের শাসনের সুবিধাভোগী, তাদের নাম দেখে বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগ বিরোধীরাই আঁতকে উঠছেন।

মির্জা ফখরুল স্পষ্টতেই এমন সংস্কারের অবসান চেয়েছেন। তিনি ভদ্র ভাষায় ইউনূসকে জানিয়ে দিয়েছেন, সংস্কারের দায়িত্ব তার মত অনির্বাচিত সরকারের না, এটা করবে নির্বাচিত সরকার।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খুশিতে গদগদ থাকার ২০ দিন পর নিজের পুরোনো কথা গিলে ফেলে এবার তিনি বলেছেন, ‘‘কয়েকজন ব্যক্তি একটা সংস্কার করে দিলেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের মাধ্যমে সেই সংস্কার আসতে হবে।”

অর্থাৎ ইউনূস সরকার এখন বিএনপির কাছে ‘কয়েকজন ব্যক্তি’ ছাড়া কিছুই না।
সরকার পতন আন্দোলনের নেপথ্যে কী খেলা হয়েছে, সেটি এখন মানুষ জানার বা বোঝার চেষ্টা করবে না, সময়ে সব ফাঁস হবে, তবে মির্জা ফখরুলের পোড় খাওয়া মস্তিস্কে বিষয়টি ধরা পড়েছে সন্দেহ নেই।

তিনি মড়িয়া হয়ে নির্বাচনের দাবি করলেন, বললেন, ““আমরা মনে করি তারা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। এই সরকারের ওপর আমাদের আস্থা রয়েছে, জনগণের আস্থা রয়েছে, সকলেরই আস্থা আছে। কিন্তু অবশ্যই সেটা (নির্বাচন অনুষ্ঠান) সীমিত সময়ের মধ্যেই করতে হবে, একটা সময়ের মধ্যে করতে হবে, যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই করতে হবে। তা না হলে যে উদ্দেশ্যে সেই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যাহত হবে।”

এত বছর ফখরুলরা যাদের সঙ্গী করে রাজনীতি করেছেন, নির্বাচন প্রশ্নে তাদের সমর্থন পাবেন কি না, সেটি এখন দেখার বিষয়।
তবে যে শক্তির ফাঁদে বাংলাদেশ পড়েছে, বিএনপি পড়েছে সেই শক্তির বিরুদ্ধে বিএনপি লড়তে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন আরও বড়।

Related posts

নতুন বাংলাদেশেও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর অবদান

Ny Bangla

সরকারকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত হচ্ছে : মির্জা ফখরুল

Ny Bangla

আসলেই কি হামিদ-আইভীকে নেতৃত্বে আনতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ?

Ny Bangla

আন্দোলনকারীদের দখলে গণভবন

Ny Bangla

বাংলাদেশে আওয়াজ উঠেছে ‘আগেই ভালো ছিলাম’

Ny Bangla

কোটা সংস্কার আন্দোলন: সংঘাতে নিহত বেড়ে ২১১

Ny Bangla

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Privacy & Cookies Policy