আওয়ামী লীগ সরকার পতনে পর নিষিদ্ধ উগ্রবাদী সংগঠনটির কার্যক্রম চলছে বাধাহীনভাবে। তারা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মুখে কুলুপ। তবে আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছেন তথ্য উপদেষ্টা।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও উগ্রবাদী ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলোর পোয়াবারো।
এরই মধ্যে মুক্তি পেয়েছেন ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার উল্লাহ বাংলা টিমের নেতা মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানী। সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে ভক্তদের উদ্দেশে খোলা জিপে করে বক্তব্যও দিয়েছেন তিনি।
হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে জড়িত উগ্রবাদী নেতারা হুমকি ধমকির শুরু করে দিয়েছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও উগ্রবাদের জন্য নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরের ফিরে আসা।
নির্বাচন নয়, সশস্ত্র পন্থায় জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী এই সংগঠনটি ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন তারা নিজস্ব ব্যানার নিয়ে নেমে পড়ে। এখন ‘সুসময়ে’ সরকার পতন আন্দোলনে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের বিষয়টিও এখন আর গোপন রাখছে না তারা। তারা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদনও করেছে।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠনের প্রতি বদান্যতা দেখিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছেন ২৮ দিনের মাথায়। এখন হিযবুত তাহরীরও আশায় আছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দুই দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশ, মিছিল ও মানববন্ধন করেছে এই উগ্রবাদী সংগঠনটি। সাদা ও কালো কাপড়ে তাদের কালেমার পতাকা দেখা গেছে সরকার পতনের এক মাস পূর্তিতে ৫ সেপ্টেম্বর শহিদি মার্চেও। ভারতের কথিত পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও মিছিল করেছে।

৫ সেপ্টেম্বরেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জননিরাপত্তা বিভাগে গিয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন করে সংগঠনটি। কিন্তু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এ বিষয়ে কথা না বলার নীতি নিয়েছেন।
১০ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুর্গা পূজা নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রশ্ন করলেও কোনো কিছু বলতে রাজি হননি উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমি পূজা সংক্রান্ত ব্যতীত কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না।’
‘এটা তো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’- এক সংবাদ কর্মী এই মন্তব্য করলে উপদেষ্টা বলেন, ‘সেটা আপনার কাছে হতে পারে। কিন্তু আমি পূজা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না।’
তবে হিযবুত তাহরীর যেভাবে প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড চলছে, তাতে তাকে আর নিষিদ্ধ সংগঠন বলার কোনো জো নেই। সরকার তাদেরকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে না, ফলে নিষেধাজ্ঞা একটি ‘অকার্যকর বিষয়’ হয়ে গেছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এ নিয়ে কিছু বলতে না চাইলেও তথ্য উপদেষ্টার প্রতিক্রিয়া বেশ নমনীয়। তিনি হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, “হিযবুত তাহ্রীর বা যে কোনো সংগঠন যদি তাদের অবস্থান ব্যক্ত করতে চায় পরিষ্কার করতে চায় সে সুযোগ আছে। তারা সরকারের সঙ্গে কথা বলুক, আলোচনা করুক। আলোচনার মাধ্যমে সেটা একটা পর্যায়ে যাবে।”
অর্থাৎ ইউনূস সরকার কাছে জঙ্গি সংগঠনকেও কাছে টানতেও আর আপত্তি করছে না। কথিত যে ইনক্লুসিভ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার কথা বলা হচ্ছে সেখানে ইসলামি উগ্রবাদীদেরকেই সমাজের মূল ধারায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে।
অথচ হিযবুত তাহরীর নিয়ে উদ্বেগ আছে খোদ মুসলিম বিশ্বে।
ইসলামি খিলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫৩ সালে সংগঠনটির যাত্রা শুরু। ফিলিস্তিনের জেরুজালেমের শরীয়াহ আদালতের বিচারপতি কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত শায়েখ তাকিউদ্দীন আন-নাবহানী এর প্রতিষ্ঠাতা।
ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে।
বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০১ সালে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে হিযবুত তাহরীর। এর নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইবিএর একজন শিক্ষক।
তারা দাওয়াহ ও জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। গণতন্ত্রকে তারা কুফরি মতবাদ বলে মনে করে। তারা ভোটে বিশ্বাস করে না, সেনাবাহিনীকে উসকানি দিয়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
তবে মুসলিম বিশ্বেই এই সংগঠনটির গ্রহণযোগ্যতা নেই। ১৯৭৪ সালে মিশরে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশে ইসলামি জাতীয়তাবাদীদের পছন্দের দেশ তুরস্কেও। বেশ কিছু আরব দেশ এমনকি পাকিস্তান সরকারও হিযবুত তাহরীরকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবেই দেখে নিষিদ্ধ করেছে। অ্যামেরিকা, ইংল্যান্ডেও তাদের তৎপরতা নিষিদ্ধ।
২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর মাসে আওয়ামী লীগ সরকার প্রেসনোট জারি করে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সেই প্রেসনোটে বলা হয়, ‘সরকারের নিকট এই মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে যে, হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশ নামীয় সংগঠনটির কার্যক্রম দেশের শান্তি শৃঙ্খলার পরিপন্থি।
ইতোমধ্যে সংগঠনটির কার্যক্রম জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হওয়ায় এবং পাকিস্তান, তুরস্ক, অ্যামেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে এক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় বাংলাদেশেও এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল।’
তবে নিষিদ্ধ হলেও হিযবুতের গোপন তৎপরতা কখনও থেমে ছিল না। বিভিন্ন পোস্টার ও লিফলেটে সেনাবাহিনীকে সরকার উৎখাতে ক্রমাগত উসকানি দিয়ে এসেছে তারা।

উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম যদিও বলেছেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিষিদ্ধ অবস্থায় আছে সে অবস্থায় কিন্তু কোনোভাবেই তারা প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম করতে পারে না, এটি আইনবিরোধী হবে’, তবে সরকার আইনবিরোধী কার্যক্রম ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে এমন উদাহরণ নেই।
সরকার পতন আন্দোলনে হিযবুত তাহরীর যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল, সেই বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন সংগঠনটির মিডিয়া সমন্বয়ক ইমতিয়াজ সেলিমও। বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি নর্থ সাউথ, ইস্টওয়েস্ট ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া কর্মীরা মাঠে ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘হিযবুত তাহ্রীর একটা বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক শক্তি। অবশ্যই আমরা মাঠে ছিলাম। কিন্তু এই আন্দোলনটা স্বতঃস্ফূর্ত যে গণঅভ্যুত্থান এটা কোনোভাবে যাতে রং না লাগে এবং কোনোভাবে যাতে এটাকে কেউ প্রভাবিত করতে না পারে আমরা খুবই সতর্কতার সাথে উইদাউট আওয়ার ব্যানার, আমরা মাঠে ছিলাম।”
১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে হঠাৎ করেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার কী কারণ, এই প্রশ্নের জবাব সম্ভবত এটিই।
সেদিন থেকেই ক্রমাগত গোলাগুলি শুরু হয়, যদিও পুরো দোষই গেছে পুলিশ ও সরকারের ওপর। সেদিন থেকে ১৯ দিনের ব্যবধানে সাড়ে ১৫ বছর শাসন করা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
সরকার পতনের দিন জামায়াতে ইসলামী ছিল নিষিদ্ধ সংগঠন। কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্যান্য দলের সঙ্গে এই নিষিদ্ধ দলের নেতা শফিকুর রহমানকে নিয়েই বৈঠক করেন, যেটি আইনের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য। পরে তিনি তাকে নিয়ে বঙ্গভবনেও যান।
তিন দিন পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। এরপর থেকে উগ্রবাদীরা যে মাথাচাড়া দেয় উঠছে, তা নানাভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে।
দেশজুড়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মাজার। কক্সবাজারে একা ভ্রমণ করতে যাওয়া নারীদের হেনস্তা করা হচ্ছে, যৌনকর্মীদের পেটানো হচ্ছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করে আছে ইউনূস সরকার, যেন কোথাও কিছু ঘটছে না। অথচ ৮ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে তিনি বলেছিলেন, ‘আর কেউ কারও ওপর হামলা করবে না।’
এর মধ্যে ২৬ আগস্ট মুক্তি পেয়েছেন আরেক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানী।
২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পর বেশ কয়েকজন ব্লগারকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় তিনি সাজাপ্রাপ্ত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের মধ্যে উগ্রবাদ ছড়ানোর পেছনে তাকে দায়ী করা হয়।
ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনসহ মোট চারটি মামলা হয়।