মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিচার করতে চায় ড. ইউনূসের সরকার। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গবেষণাও করে ফেলেছেন। এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনালে জমা পড়েছে আবেদন!
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইনের শিক্ষক আসিফ নজরুল আইন উপদেষ্টা হয়ে যে খেলাটা দেখাতে যাচ্ছেন, সেটি হল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার।
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত সহিংসতা অনেক হয়েছে। বহু মানুষের প্রাণ গেছে। কিন্তু এই প্রাণহানিকে ‘গণহত্যা’র সংজ্ঞায় ফেলতে হলে আসিফ নজরুলকে নতুন করে গণহত্যার সংজ্ঞা তৈরি করতে হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা সরকার ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী, সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে।
প্রতিটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে অ্যামেরিকা থেকে অনুরোধ এসেছে এই দণ্ড না দিতে। সে সময় আসিফ নজরুলও এই বিচারের বিরুদ্ধে ছিলেন, তারা তথাকথিত আন্তর্জাতিক মানের বিচারের ধোঁয়া তুলেছিলেন।
অথচ আইন উপদেষ্টার চেয়ারে বসতে না বসতেই এখন তিনি এই সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণহানিকে ‘গণহত্যার’ আওতায় আনতে গবেষণার কথা বলেছেন।
“গণহত্যা এবং গুলিবর্ষণ এই সমস্ত ঘটনার জন্য কিছু মামলা হয়েছে আপনারা জানেন। রাজপথে থাকা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী দাবি করেছেন যে, এটাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিচার করার স্কোপ আছে কি না। আমরা সেটা খতিয়ে দেখেছি।
“১৯৭৩ সানের যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইবুনাল অ্যাক্ট আছে, যেটা পরে ২০০৯ ও ২০১৩ সালে সংশোধন হয়েছে, সেই আইনে আমরা জুলাই গণহত্যা, জুলাই গণহত্যা বলতে আমরা অগাস্টের প্রথম পাঁচ দিনের গণহত্যাও বোঝাচ্ছি, এটার জন্য দায়ী যে ব্যক্তিবর্গ আছেন, উনাদের বিচারের জন্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উনাদের বিচারের জন্য আমরা ইতোমধ্যে একটা ছোটখাটো গবেষণার মত করেছি; করে দেখেছি, এই আইনের অধীনে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা, যারা আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব।”
সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুনির্দিষ্টভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ওইসব ঘটনার বিচারের উদ্যোগ নিচ্ছে কি না, তা জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা।
জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “আইসিটিতে বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হবে, এটা ক্যাটাগরিকালি বলতে পারেন।”
জুলাই থেকে সংঘর্ষে শুরুর দিকে গুলিতে বেশিরভাগ প্রাণ গেছে। কিন্তু সেই গুলি যে পুলিশই করেছে, সেটি নিশ্চিত নয়, তা মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেছেন, “টার্গেট কিলিং হয়েছে এবং তার কাছে খুবই আশ্চর্য লাগছে যে পুলিশের গুলিতে কম মানুষ মারা গেছে। ৭.৬২ রাইফেলের গুলিতেই নিহত হয়েছে বেশিরভাগ মানুষ। এই অস্ত্র বেসরকারি খাতে নিষিদ্ধ। সেই অস্ত্রে এত মানুষের মৃত্যু কীভাবে হল, সেটি নিয়ে তদন্ত হবে।”
আসিফ নজরুল কিন্তু এর ধার ধারছেন না।
সরকার পতন আন্দোলনে হেরে গেছেন শেখ হাসিনা। গুলিতে বহু প্রাণহানির তথ্য সামনে এসেছে। তবে অপর পক্ষে পিটিয়ে, পুড়িয়ে, কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও কম না।
সেই ছবিও কম না, তবে এগুলো এতটাই নৃশংস, এতটাই বীভৎস যে সেগুলো পোস্ট করা মাত্রই সামাজিক মাধ্যম তা মুছে দেবে। অর্থাৎ দুই পক্ষের শক্তি প্রয়োগের মধ্যে এক পক্ষেরটাই কেবল সামনে আসছে, আরেক পক্ষেরটা পাচ্ছে না গুরুত্ব।
আবার আসিফ নজরুল কেবল ৫ আগস্টের আগের মৃত্যুর কথা বলেছেন। এর মধ্যে ৪ ও ৫ আগস্টের প্রায় সব মৃত্যুই কিন্তু হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থক, নেতাকর্মী আর পুলিশের।
৫ তারিখের পরে প্রতিদিনই যে হত্যা হয়েছে, সে সংখ্যাটা এরই মধ্যে তিনশ ছাড়িয়ে গেছে বলে পত্র পত্রিকায় এসেছে। আগেরগুলো গণহত্যা হলে পরেরগুলো গণহত্যা হবে না।?
এক দিনে আপিল বিভাগের ছয় জন বিচারপতির পদ খেয়ে দেওয়া, ঝড়ের বেড়ে রাষ্ট্রের উচ্চপদে চাকরিজীবীদের নিয়োগ বাতিল করে ফেলার পর এবার মনে হয় ঝড়ের বেড়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতিশোধও নিয়ে নিতে চাইছেন আসিফ নজরুল
তিনি এমন বক্তব্য রাখার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত ’হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনের’ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছেন এক আইনজীবী।
সেই আবেদনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আরও ৯ জনের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন জানানো হয়েছে।
আন্দোলনের সময় নিহত বাগেরহাটের আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা মো. বুলবুল কবিরের পক্ষে এই আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম।
সেই আবেদন গ্রহণ করা ছাড়া উপায় ছিল না ট্রাইব্যুনালের পক্ষে। তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. আতাউর রহমান বলেছেন, “আমরা অভিযোগটি গ্রহণ করেছি। এরপর পেপার ওয়ার্ক হবে, আমরা ঘটনাস্থলে যাব, সারাদেশে যেখানে যেখানে ঘটনা হয়েছে সব জায়গায় গিয়ে তদন্ত করা হবে। তারপর প্রতিবেদন জমা দেব।”
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে দ্বিতীয় দফায় শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
সেই ট্রাইব্যুনালে তদন্ত বিচার, রায় প্রদান, আপিলে কোনা তাড়াহুড়ো করা হয়নি। এমনকি যুদ্ধাপরাধের বিচার না করে করা হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার।
এখন যে গণহত্যার দাবি করা হয়েছে, সেটি কি আসলে হয়েছে? গণহত্যার আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাটি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও শাস্তি সংক্রান্ত কনভেনশনে বলা হয়েছে, কোনো একটি জাতীয়, জাতিগত, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সংঘটিত হয়েছে: (ক) দলের সদস্যদের হত্যা করা; (খ) গ্রুপের সদস্যদের গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা; (গ) ইচ্ছাকৃতভাবে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে এর শারীরিক ধ্বংস ঘটাতে গণনা করা জীবনের গোষ্ঠীগত অবস্থার উপর আঘাত করা; (ঘ) গ্রুপের মধ্যে জন্ম রোধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা আরোপ করা ; (ঙ) গ্রুপের বাচ্চাদের জোর করে অন্য গ্রুপে স্থানান্তর করা।”
গণহত্যার কমিশন ছাড়াও, কনভেনশন আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ষড়যন্ত্র, উসকানি, প্রচেষ্টা এবং গণহত্যায় জড়িত হওয়াকে শাস্তিযোগ্য করে তোলে।
এবার প্রশ্ন হল গত ১৮ জুলাই থেকে সংঘর্ষে প্রাণহানি হয়েছে দুই পক্ষে। দুই পক্ষেই মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ হয়েছে। পুলিশ অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে থাকলে হত্যার দায়ে তার বিচার করা উচিত, সেই সঙ্গে থানায় ঢুকে যে পুলিশ সদস্যদেরকে পিটিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে, মরদেহ গাছে, ফুটওভার ব্রিজে ঝুলিয়ে উল্লাস করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ঢুকে নেতাকর্মীদেরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, বিচার তো সেগুলোরও করতে হবে।
কিন্তু আসিফ নজরুল একতরফা এক পক্ষের কথা বলে কী ন্যায়বিচার করতে চাইছেন? এত বছর তিনি মুখে যে কথাগুলো বলেছেন, চেয়ারে বসেই উল্টো কথা বলছেন।
নিজামী ও মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছে একাত্তরের খুনি বাহিনী আলবদর সদস্যদের বুদ্ধিজীবী হত্যার সুপ্রিম রেসপনসিবিলিটির দায়ে। আসিফ নজরুল এবার পুলিশের বিরুদ্ধে তথাকথিত গণহত্যার অভিযোগ এনে সেই রেসপনসিবিলিটি সরকারের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার ওপর চাপাতে চাইছেন।
তাহলে সেটি কি ২০১৩-১৪ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের প্রতিশোধ?
এতদিন ঢালাও মামলার তীব্র সমালোচনা করলেও আজ শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা হচ্ছে। একজন খুন হয়েছে, একজন অপহরণ হয়েছে, একজন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সেসব ঘটনায় দায়ীদেরকে আসামি না করে আসামি করা হচ্ছে শেখ হাসিনা এবং তার দল ও সরকারের শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিদের।
গত ১৬ জুলাই ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় সংঘাতে নিহত ছাত্রলীগ কর্মী সবুজ আলী ও হকার মো. শাহজাহানের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। যদিও সেই ঘটনায় মামলা আগেই হয়েছে এবং সেখানে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য এবং মরদেহ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পুলিশ যে সুরতহাল প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে এই হত্যার জন্য কোটাবিরোধীদেরকে দায়ী করা হয়েছে।
আদালতে শুনানিতে আনিসুল ও সালমানের পক্ষে কোনো উকিলকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। এসব দেখে এমনকি মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানও সমালোচনা করছেন। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার মুখে মানবাধিকারের কথা যে ফাঁকা বুলি, সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন।