নাসরিন খন্দকার, লেখক
স্বৈরাচারমুক্ত হবার খুশিতে আর আশাতে নানা জনে তাঁদের চাওয়া ব্যক্ত করছেন। কেমন বাংলাদেশ চাই, কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই, ইত্যদি ইত্যাদি। এগুলো খুবই আশা জাগানিয়া, এই অর্থে যে, আমরা মনে করছি আমাদের চাওয়ার কদর হলেও হতে পারে। তো আমিও এই ট্রেন্ডে আমার একটা ছোট্ট চাওয়া, কেমন সংহতি চাই তা নিয়ে বলছি।
তার আগে বলি কেমন সংহতি চাইনা। আমি ব্যাটাতান্ত্রিক সংহতি চাই না।
আমি জানি এইটুকু পড়েই অনেকেই আর বাকিটুকু পড়বেন না। সেইটা জেনেই লিখছি। তো ব্যাটাতান্ত্রিক বলতে আমি আসলে কি বুঝাচ্ছি?
আমরা অনেকেই পিতৃতন্ত্র কী জানি অথবা না জানলেও কিছু একটা বুঝে নিই। পিতৃতন্ত্র হইল বাপের মালিকানা। মানে এর ভিত্তিমুলে সম্পত্তি সম্পর্ক আছে। বাপের উত্তরাধিকার, বংশ ইত্যাদি আছে। আমাদের নিজস্ব ফ্যাসিবাদ এরকম পিতৃতান্ত্রিক ছিল। যদিও একজন নারী তা কায়েম করেছেন। এই ব্যাখ্যায় এখন যাবনা, আলসি লাগে।
অনেকেই পিতৃতন্ত্র না বলে পুরুষতন্ত্র বলেন। আমার কাছে সেইটা একটু সমস্যাজনক লাগে। কারণ পুরুষতন্ত্র বল্লে পিতৃতন্ত্রের যে কাঠামোগত চেহারা তা আড়ালে চলে যায়। তো আমি তাহলে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র না বলে ব্যাটাতন্ত্র কেন বলছি? পিতা, পুরুষ আর ব্যাটা কি সমর্থক? আমি তা মনে করিনা। সে আলাপেও যাবনা, আলসি লাগে।
এইখানে ব্যটা বলতে আমি বুঝাচ্ছি এমন সব আগ্রাসী, দাম্ভিক, সহমর্মহীন বৈশিষ্ট্য যেগুলোকে আমাদের এই প্রতিযোগিতাপূর্ণ সমাজে পুরস্কৃত করা হয়। পুরুষদের এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করার জন্যে সামাজিক চাপ দেয়া হয়। এই ‘গুণাবলী’ অর্জন না করতে পারলে মেয়েলি বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়।
মায়া মমতার প্রকাশকে তিরস্কৃত করা হয়। ফলে মায়া, মমতা, সহমর্মিতা, বিনয় ইত্যাদি অতি মূল্যবান মানবীয় গুণাবলী অর্জন থেকে বেশিরভাগ পুরুষই বঞ্চিত থাকেন। পিতৃতন্ত্রের শিকার এই অভাগা পুরুষরা মানবিক হতে পারেন না, ব্যাটা হয়ে উঠেন। কিন্তু পেশাগত ক্ষেত্রে পুরস্কৃত হন। কারণ আমাদের এই জগতটা আগ্রাসী, প্রতিযোগিতা মূলক।
অন্যকে ছোট করেই বাকিদের টপকে উপরে উঠতে হয়। মমতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি ইতিবাচক অনুভূতির প্রকাশকে এই জগত দুর্বলতা ও মেয়েলী মনে করে। অন্যদিকে ক্রোধ, প্রতিহিংসা ইত্যাদি অনুভূতিকে পুরুষালী এবং সক্ষমতা মনে করা হয়, কারণ এই অনুভূতিগুলো ‘ব্যাটা’ অনুভূতি।
অন্যদিকে নারীদের ক্ষেত্রে হয় উল্টোটা। নারীদের ক্ষেত্রে আগ্রাসী, প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, অহংকার কে দারুণভাবে তিরস্কৃত করা হয়, মমতাময়ী হয়ে উঠতে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু মুশকিল হোল, নারীরা এই গুণাবলী দিয়ে প্রতিযোগিতায় উপরে উঠতে পারেননা। এই জগতে সফল হতে হলে, এই ‘ব্যাটা’ আচরণগুলোই পুরস্কৃত হয়। ফলে অনেক নারীও নিজেকে ব্যাটা প্রমাণ করতে চান, হয়ে উঠেন।
আমরা তাই পচ্চুর নারী ব্যাটাও দেখতে পাই চারপাশে।
তো আমি এই ব্যাটাতান্ত্রিক পরিবেশের বিলুপ্তি চাই। নতুন প্রাপ্ত এই বাক স্বাধীনতায় আমি চাই আমরা শুধু বলতে না, সহমর্মি হয়ে শুনতে শিখি। আমি চাই একে অপরকে খারিজ করার প্রবণতা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারি।
আমাদের মধ্যে যখন কেউ একজন তার ভয়, আশা বা আবেগের কথা প্রকাশ করবে আমি চাই তার উত্তরে অন্য কেউ বলে না উঠে, আমি তো আগেই বলেছিলাম। অথবা, তো আপনি কি ভেবেছিলেন? বা এরকম তো সবসময়ই হয়, আপনার চোখে পড়েনি কেন? অথবা এইটা নিয়ে এখন কথা বলছেন তখন ঐটা নিয়ে বলেননি কেন? অথবা এতদিন পরে কেন বলছেন?
এরকম আরও অনেক ধরণের প্রতিক্রিয়া আমরা প্রতিদিন কাছের মানুষজনের কাছ থেকেই পাই। এগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ধাক্কা দেয়। অনেকে নৈকট্যের উসিলাতেও অনেক সময় ছোট করে এরকম কথা বলেন।
ভিন্নতাকে শুধু ‘টলারেট’ বা সহ্য করলেই তো হয় না, ভিন্নতাকে সম্মান প্রদর্শনও করতে হয়। আমাদের মনে হয় এই অভ্যাসটা একেবারেই নাই। মৃদুভাষী বিনয়ী মানুষকে তাই আমরা পিছনে ঠেলে দেই।
‘আমিময়’ হয়ে অপরকে তুচ্ছ করে কথা বলাকেই তাই অনেকে গর্বের বিষয় মনে করেন এই বলে যে ‘আমি কাউকে আরাম দেইনা’। কিন্তু এই রকম প্রতিক্রিয়াগুলো আসে ব্যটাতান্ত্রিক প্রবণতা থেকে, যেখানে (মেয়েলি) আবেগকে যুক্তির থেকে ছোটো করা হয়।
যিনি বলছেন, তাঁকে না শুনে একভাবে ছোটো করে, নিজেকে মহাজ্ঞানী হিসেবে প্রকাশ করে। আর এরকম মানুষদেরকে সবাই বেশ ভয় পায়, কিছুটা তোয়াজ করে চলে, সবাই মনে করেন ওঁরা অনেক বুঝেন। মনে করা হয় যেন ওঁরা আবেগ নয়, যুক্তি দিয়ে চলেন তাই সবকিছু সবসময় আগে থেকেই বুঝতে পারেন।
আমরা বাক স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছি, কিন্তু শুনবার কান, বোঝার মন আমাদের নিজেদেরই অর্জন করতে হবে। চাটুকার আর ব্যাটাবাদী দুই ধরনের আচরণই তাই সংহতির জন্যে ক্ষতিকর। আমি তাই ছিদ্রান্বেষী না হয়ে, শোনার কান নিয়ে আর মমত্ববোধ দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে ধরার মতো সংহতি চাই।
previous post