মাহফুজ আব্দুল্লাহ,
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস পর কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, গন্তব্য কোথায়? খোদ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের স্পষ্টতেই জঙ্গিবাদের উত্থানের ভয় পাচ্ছেন। এমনকি তিনি নিজের জীবন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর পর আক্রান্ত হয় বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের সব ভাস্কর্য। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া জাতীয় সংগীত আর সংবিধানের ওপর আক্রমণ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী দাবি তুলেছেন, পাল্টাতে হবে জাতীয় সংগীত আর সংবিধান।
এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তারা জাতীয় সংগীত গেয়েই এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন জেলায় জেলায়। কিন্তু স্বাধীন এই দেশে সিলেটে বাতিল করতে হয়েছে সেই আয়োজন। কারণ, প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে তারা নিরাপত্তা দিতে পারবে না।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা গনিমতের মাল হিসেবে লুটে নেওয়া হচ্ছে ৫ আগস্ট থেকেই।
এবার আক্রমণের মুখে মাজার, যে মাজারগুলো ১৯৭১ সালে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্র। শুরুতে ভাঙা হয়েছে সিরাজগঞ্জের একটি মাজার। এবার সিলেটের শাহ পরান (র.) এর মাজারও নিশানায়। হুমকি ধমকিয়ে দিয়ে এসেছে। নারায়ণগঞ্জে দেওয়ানবাগের মাজারে হামলা, লুটপাট করে আগুন দেওয়া হয়েছে, যে ঘটনাটি ৫ আগস্টের পর সাধারণ এক চিত্রে পরিণত হয়েছে।
সরকার পতন আন্দোলনে ডান-বাম সব ছিল এক দিকে। এখন বামদের পাত্তা নেই, ডানপন্থি অর্থাৎ উগ্রবাদী ইসলামী শক্তিগুলো দিনে দিনে সামনে আসছে। দল হিসেবে বিএনপির তুলনায় জামায়াত বলতে গেলে কিছুই না, কিন্তু এই মুহূর্তে সংবাদ মাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমে জামায়াতের জয়জয়কার।
যাত্রাবাড়ীতে সংঘাতে পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনায় শিবির কর্মীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে তোলার পর তার ১৭ বছর বয়স দেখে অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন। চাপের মুখে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্যও হয় সরকার।
সে সময় সেই কিশোর নিজের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন করেছেন। অথচ জামায়াত নেতা শফিকুল ইসলাম মাসুদ এক দলীয় সভায় সেই কিশোরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন শিবিরের সাথি হিসেবে। বলেছেন, এখন আর মুখ ঢাকার কিছু নেই। এখন মুখ খুলে বুক ফুলিয়ে চলার সময়।
বড় বড় সমাবেশ করছে কওমিপন্থিরাও। বিএনপি কিছুদিন নির্বাচন নির্বাচন জপে এখন চুপ, জামায়াত সাফ জানিয়ে দিয়েছে এখন ভোটের সময় নয়।
কিন্তু যে শক্তির উত্থান হচ্ছে, তা নিয়ে ভীত স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ। তিনি ফেসবুকে দীর্ঘ পোস্ট দিয়ে মাজার ও ইসলামের বিভিন্ন তরিকা এবং মাসলকের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
মাহফুজ লিখেছেন, ‘আজ মাজার ভাঙবে, কাল সত্যপন্থি পীরদের দরগা দরবার ভাঙা হবে, পরশু ভিন্ন তরিকার মসজিদ ভাঙা হবে- এসব নৈরাজ্য যারা করে বেড়াচ্ছেন, তারা ইসলাম ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। বাংলাদেশের জনগণকে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ইসলামের বৈচিত্র্য রক্ষা করতেই হবে।’
কিন্তু রুখে দাঁড়াবে কে? দেশে এখন পুলিশের অবকাঠামো যেটুকুই আছে, তারা ব্যস্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তারে, তার উগ্রবাদীদের বিপক্ষে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার মত কেউ নেই। দিনাজপুরে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানকে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন যেভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, তা নজিরবিহীন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এই অভ্যর্থনা পাবেন না।
মাহফুজরা কথিত ইনক্লুসিভ সোসাইটি তৈরির কথা বলে ইসলামপন্থি দেশ গড়তে চাইছে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চরিত্র পাল্টে ফেলতে চাইছে তারা। কিন্তু যাদের ওপর ভরসা করে তারা এতদূর এগিয়েছে, সেই তারাই এখন দাঁত-নখ বিঁধাতে চাইছে।
মাহফুজ লিখেছেন, ‘এক জালেম আজকে আমাকে নাস্তিক ইসলামবিদ্বেষী বলেছেন। এ মিথ্যুক ফাসিক খোঁজ নিয়ে কথা বলে নাই। ইন্নাজ জন্না আকযাবুল হাদিস। অনুমান নির্ভর কথা বলে ওরা আমাদেরকে হত্যাযোগ্য করে তুলছে৷ ওরা তো বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষকেই মুসলমান মনে করে না।’
অর্থাৎ, কেবল সারা দেশের মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় না, স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী নিজেরও নিরাপত্তার বোধ নেই। তিনিও খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।
মাহফুজ লিখেছেন, ‘আমরা ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে, ট্যাগিং এর রাজনীতির বিরুদ্ধে, বাঙালি মুসলমান, সর্বোপরি বাংলাদেশের নাগরিকিদের হত্যাযোগ্য করার বিরুদ্ধে লড়েছি। নিপীড়িত হয়েছি। কিন্তু, আজ আমাদেরকে এ জাহেলরা হত্যাযোগ্য করে তুলেছে।’
উগ্রবাদীরা যা যা করতে চায়, সে কথা বহু বছর ধরেই আওয়ামী লীগ সরকার সতর্ক করে আসছিল। কিন্তু পাত্তা দেয়নি অনেকে। আজ মাহফুজও বলছেন সে কথাই। তিনি লিখেছেন. ‘তারা আগামী কালকে আমাদের হত্যা করে, প্রথমে শিয়াদের হত্যা করবেন, তারপর কাদিয়ানী, তারপর পীর ও পীরের মুরিদদের, তারপর গণতন্ত্রপন্থী আলেমদের, তারপর পাবলিক প্লেসে হাজির মুসলিম নারীদের, তারপর কোনোভাবে ‘তাদের ইসলামের’ বিরুদ্ধে যায় সবাইকে হত্যা করে দেশটা হিন্দুত্ববাদীদের বিচরণ ক্ষেত্র বানিয়ে ফেলবেন। এ দেশের না ইনারা, উনারা ভিনদেশের এজেন্ট। খুবই স্পষ্ট ইনাদের মিশন।’
২০০১ থেকে ২০০৬ সালে জঙ্গিবাদের উত্থানের যে কথা এতদিন মাহফুজরা ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল, আজ সেই তারাই সে কথা সামনে আনছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লিখেছেন, “ভুলে যাবেন না, জঙ্গিবাদীরাই সাবেক বিএনপি-জামায়াত সরকারকে ব্যর্থ করে দিয়ে আওয়ামী ‘ফ্যাসিবাদীদের’ দীর্ঘদিনের জন্য ক্ষমতায় বসিয়েছিল।”
অর্থাৎ জঙ্গিবাদ যে ফিরে আসছে, সে বিষয়টি দিব্যচোখে দেখতে পারছেন মাহফুজ, যাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগর হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি লিখেছেন, ‘মুজিববাদীরা আমাকে অভ্যুত্থানের আগে খুঁজেছে, এখন জঙ্গিবাদী খারেজিরা খুঁজবে। আল্লাহর কাছে আমার জবাবদিহি করতে হবে। আমি কোন খারেজি তাকফিরি ইসলামপন্থির ফতোয়াবাজির অধীন না।’
পরিণতি যে ভালোর দিকে যাচ্ছে না এবং তার জীবনও যে হাতের মুঠোয়, সেই শঙ্কারও কথাও উঠে এসেছে মাহফুজের পোস্টে। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের হত্যার পরিস্থিতি তৈরি কিরে লাভ নাই। নবীজির ভালোবাসায় আমরা হাসতে হাসতে মরে যাব। আমরা তো মরতেই রওনা দিসি (দিয়েছি)। এ দায়িত্ব, পদবি আর খ্যাতি ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু, আবেহায়াত তো আখেরাতে নবীজির সাথে দিদার!’
কথা হল প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ভয় পেয়েছেন কেন? এর জবাব সম্ভবত মাজারে হামলায় নয়, আরও স্পষ্ট হয়েছে খুলনায়।
সেখানে এক হিন্দু কিশোরকে ফেসবুকে ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করিয়ে তার ধর্মকে আক্রমণ করে পাল্টা জবাব বের করা হয়েছে। পরে তাকে আক্রমণ করার মন্তব্যগুলো মুছে দিয়ে সেই হিন্দু তরুণের জবাবগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে মনে হয়েছে তিনি মহানবী (স.) কে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। পরে পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে ঢুকে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে তাকে বেদম পেটানো হয়েছে।
শুধু তাই না, তাকে হত্যা করা হয়েছে, এমন ঘোষণা দিয়ে বুনো উল্লাস করা হয়েছে, ফেসবুক লাইভে শত শত বা হাজার হাজার মানুষ তাকে উল্লাস করেছে। সেনাবাহিনী তখন ঘোষণা দিয়েছে, সেই কিশোর মারা গেছে, হামলাকারীরা যেন বাড়ি ফিরে যায়। একই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে মসজিদে।
পরের দিন অবশ্য সেনাবাহিনী থেকে দাবি করা হয়েছে, সেই কিশোর বেঁচে আছে এবং তার জীবন সংকটাপন্ন নয়।এর মধ্যে চট্টগ্রামে ঘটে গেছে আরেক ঘটনা।
গণেশ পূজা উপলক্ষে মৃৎশিল্পী উত্তম পালের কারখানা থেকে ভ্যানে করে প্রতিমা নিয়ে যাচ্ছিল ব্যাটারি গলি ধোপাপাড়া পূজা উদ্যাপন পরিষদের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক। প্রতিমাটি জামালখানের মোমিন রোডের কদম মোবারক মাদ্রাসার সামনে পৌঁছালে উপর থেকে গরম পানি নিক্ষেপ করে।
স্বেচ্ছাসেবকরা মাদ্রাসার সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠে দুষ্কৃতকারীদের ধরতে যায়। কিন্তু তাদেরকে মাদ্রাসায় আটকে ফেলা হয় এবং দুইজনকে বেঁধে রেখে প্রায় ঘণ্টাখানেক নির্যাতন করা হয়। আহতদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম মেডিকেলে জরুরি বিভাগে ভর্তি।
এই সংবাদে উত্তাল হয়ে উঠে জামালখান ও মোমিন রোড এলাকা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কদম মোবারক মাদ্রাসা ঘেরাও করে রাখে। চরম উত্তেজনার মধ্যে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী পৌঁছে। এই ঘটনা নিয়ে যদি বাড়াবাড়ি হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পথে হাঁটবে বাংলাদেশ।