New York Bangla Life
বাংলাদেশবিশেষ প্রতিবেদন

গাজী গ্রুপ কি গনিমতের মাল? ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়ে’ সংবাদ মাধ্যম কেন ঘুমিয়ে


বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় টায়ার কোম্পানি গাজী টায়ার ফ্যাক্টরিতে লুটপাট শুরু হয় রোববার বিকালে। এরপর রাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

রাতেই কিছু কিছু পত্রিকার অনলাইন পাতায় এই সংবাদ অল্প করে আসতে থাক। কিন্তু ঘটনা কী ঘটেছে তা আর জানানো হয়নি। কেবল একটি লাইন বলে দেওয়া হয়, এটি নাশকতার আগুন। কিন্তু সেটিও ভেতরে।

অথচ সন্ধ্যার পরেই ফেইসবুকে কেউ কেউ এই লুটপাটের কথা লিখতে থাকে, কিন্তু দেশের গণমাধ্যমে সেসব স্থান পায়নি।

ঘটনাস্থল নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ ঢাকা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে। এই সময়ে কিছু একটা ঘটলেই ফেইসবুকে লাইভ বা ভিডিও বা পোস্টের ছড়াছড়ি হয়ে যায়, কিন্তু গাজীর এই ঘটনা নিয়ে লেখালেখিও হয়নি খুব একটা।

কেন সেটা হয়নি, তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেল কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিজের গাড়িতে করে আসা খোজিৎসা বেগম জোনাকি নামে একজনের ফেসবুক এক পোস্টে।
রোববার মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ পর থেকেই নরসিংদী শহরের পর থেকেই তীব্র যানজটে পড়েন তিনি। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কাছে এসে ঘটনাটা বুঝলেন। কয়েক কিলোমিটার আটকে দিয়ে গাজী টায়ার কারখানায় লুটপাট চলতে দেখেন।

শত শত গাড়ি মহাসড়কে দাঁড় করিয়ে রেখে শত শত পিকআপ ভ্যান, রিকশা, অটো, ভ্যান দিয়ে মালামাল সরানো হয়।

শত শত ছেলেকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে রাস্তা অবরোধ করতে দেখেছেন এই নারী। তাদের সবার মুখে ছিল কালি মাখানো, শর্ট প্যান্ট আর মাথায় ছিল কাপড় বা গামছা।
তারা গাড়ির কাছে গিয়ে চিৎকার করছিল, বলছিল ভিডিও করলেই ভাঙচুর করবে। এমনকি মোবাইল ফোনে লাইট জ্বলতে দেখলেই ধমক দিচ্ছিল। এভাবে আড়াই ঘণ্টা ধরে লুটপাট দেখেও কেউ সাংবাদিকদের জানায়নি, এটা অবিশ্বাস্য কথা।

তাহলে সেই সংবাদ অনলাইন বা পত্রিকায় আসেনি কেন?

গভীর রাতে রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আর কালবেলা ছোট করে আগুনের তথ্য প্রকাশ করেছে, তবে সকালে বিডিনিউজ বেশ বড় করে লুটপাটের তথ্য, লুটপাট চালাতে গিয়ে আগুনে শতাধিক মানুষের নিখোঁজের তথ্য প্রকাশ করে।

এরপরেও প্রথম আলোর ঘুম ভাঙতে সময় নেয় আরও কয়েক ঘণ্টা। সোমবার দুপুরের দিকে তারা খবরটি প্রকাশ করে। দুপুরের পর পর নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭৪ বা ১৭৫ জনে।

এরপর আর টেলিভিশনগুলোর পক্ষে আসলে সংবাদটি চেপে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু লুটপাটের কথা যতটা সম্ভব চেপে গিয়ে মানুষে নিখোঁজ থাকার বিষয়টিই সামনে আনে তারা। কিন্তু তারা যে লুট করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে, পারলে সে তথ্য গোপন করার চেষ্টাও লক্ষণীয়।

এই লুটে কারা ছিল, সেসব কোনো তথ্যই আসেনি এসব সংবাদে। অথচ এই প্রশ্ন একটি মৌলিক বিষয় ছিল।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার তো সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলেছে, কিন্তু সংবাদ মাধ্যম এত বড় ঘটনা কেন চেপে যেতে চেয়েছে?

নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকদের তথ্য বলছে, নিখোঁজ মানুষদের কথা বলা কী দরকার, এমন কথা বলে প্রেস ক্লাবে ফোন এসেছে। আর ফায়ার সার্ভিস বেশ কয়েক ঘণ্টা নিখোঁজের তালিকা করার কথা বললেও সন্ধ্যার পর এমন তালিকা করার কথা অস্বীকার করেছে।

এই কারখানাটি আকারে বিশাল, ৪৩ একর জুড়ে, সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ও সরঞ্জাম ছিল। এখানে যে কোনো আক্রমণই বড় সংবাদ হওয়ার কথা। কিন্তু লুট করে আগুন দেওয়ার পরেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেপে যাওয়াই প্রমাণ হয় সংবাদ মাধ্যম এক ভয়াবহ ভীতির মধ্যে আছে।



এই খবরটি তো তাও এসেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন নারায়ণগঞ্জেই গাজী ট্যাংকের আরেকটি কারখানায় একইভাবে লুটপাট চালানো হয়।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, হিউম্যান হলার, রিকশা ভ্যান বা অন্যান্য বাহনে যার যা খুশি মালামাল নিয়ে গেছে। কারও বাধা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। কারখানার সব কিছুই লুট করে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন।

একজন বড় ব্যবসায়ী নেতা, যিনি একটি টেলিভিশন এবং একটি পত্রিকার মালিক, তিনি আওয়ামী লীগের পতনের পর নতুন সরকারকে বিপুল উৎসাহের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, সেই তিনিও গাজী কারখানায় এই লুটপাটের কথা বলেছেন। জানিয়েছেন হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ লুট হয়েছে। কিন্তু তার গণমাধ্যমই এই সংবাদ প্রচার করেনি।

না প্রথম আলো, না ডেইলি স্টার, না কালের কণ্ঠ, না সমকাল, না দেশ রূপান্তর, না কোনো অনলাইন পত্রিকা, কোথাও এই সংবাদ আসেনি। হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটের ঘটনাও সংবাদ হওয়ার মত যথেষ্ট মনে হয়নি দেশের গণমাধ্যমের কাছে।

এমনকি গাজী গ্রুপের দ্বিতীয় কারখানা লুট হয়ে যাওয়ার পরেও আগের কারখানা লুটের তথ্য স্থান পায়নি সংবাদ মাধ্যমে।

এই গাজী গ্রুপ কিন্তু একজন কিংবদন্তি তুল্য মুক্তিযোদ্ধার সম্পদ। ১৯৭১ সালে ঢাকা শহরে অপারেশন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী গড়ে তুলেছেন এই প্রতিষ্ঠান। তিনি নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারে দুই বারের মন্ত্রী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার-ইত্যাদি অভিযোগও কখনও আসেনি।

সরকার পতনের পর মনে হচ্ছে তার এই সম্পদ গনিমতের মাল হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নেতার প্রতিষ্ঠান, তাই লুট করা যেন জায়েজ হয়ে গেছে।

আসলে গোটা দেশটাই এখন গনিমতের মালের মত। জোনাকির এই পোস্টে গাজীর কারখানা লুটপাট ছাড়াও আরও কিছু কথা ছিল।

রূপগঞ্জের সেই জায়গাটা পার হয়ে স্টাফ কোয়ার্টার রোড দিয়ে ঢাকায় আসেন তিনি।
জোনাকি লেখেন, ‘আসার পর দেখি সব দোকানপাট সাটার দেয়া, কিছু লোক ঘুরছে, কয়েকজনকে দেখলাম বড় শাবলে দোকানের শাটার ভাঙছে।’

এইরকম অরাজকতা, আতঙ্ক কতদিন চলবে?-জোনাকি প্রশ্ন রেখে যান তার পোস্টে। তবে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কেউ নেই।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘এখন থেকে কেউ কারও ওপর হামলা করবে না’। কিন্তু প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল, দেশে কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। তারা ব্যস্ত কেবল উচ্চ পদে রদবদলে।

এত বড় ঘটনার পর সরকারের শিল্প বা বাণিজ্য উপদেষ্টা বা শ্রম ও কর্মসংস্থান বা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কোনো কথা বলেননি। অথচ গাজীর ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানে বহু হাজার মানুষের পথে বসে যাওয়া, কর্মসংস্থান, ব্যবসা হারিয়ে ফেলা।

ড. ইউনূস আওয়ামী লীগ সরকারের পতনকে বিপুল উৎসাহের সঙ্গে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলেছিলেন। কিন্তু দেশটা যে লুটপাটের স্বাধীনতা হয়ে গেছে, সে বিষয়ে তিনি পুরোপুরি চুপ। যে সংবাদ মাধ্যমগুলো দ্বিতীয় স্বাধীনতা লেখা শুরু করে, তারা সংবাদ প্রকাশ নয়, যেন গোপন করার স্বাধীনতায় মজেছে।

Related posts

মাজারে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার

Ny Bangla

সরকারি সব কর্মচারীকে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে

Ny Bangla

আমির হোসেন আমু ও শমী কায়সার গ্রেপ্তার

Ny Bangla

খুলনায় শিক্ষার্থী পুলিশের সংঘর্ষে রণক্ষেত্র

Ny Bangla

বিমানবন্দর থেকে মন্ত্রী-এমপিদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে

Ny Bangla

সরকার এবং আন্দোলনকারীদের মতলব কী? || কোন পথে বাংলাদেশ

saeimkhan

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Privacy & Cookies Policy