সিরাজুল হোসেন, লেখক
এই বোজো মব রেভ্যুলুশনের আগে ২০০৩/৪ সালের পর থেকেই আমাদের দেশে একটা ক্রম প্রসারমান ইভিল রেভ্যুলুশন হয়েছে। সেই রেভ্যুলশন হল সাইকোপ্যাথদের ক্রমেই সরকারী বেসরকারী নানা প্রতিষ্ঠানের শিখরে আরোহন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সিভিল মিলিটারি জগাখিঁচুড়ি। ২০১৮ তে এসে সেটাতেই নির্ভর করে দেশ চালানোর চেষ্টা হয়েছে। সেই ২০২১ সালেই লিখেছিলাম দেশ পরিণত হচ্ছে ইভিল স্টেটে। লিখেছিলাম আমাদের পরিণতিও হবে নিজের দেশের শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবতা ধ্বংশ হওয়া। নিজের দেশে আগুন লাগা।
———————-
আপনি যদি কিছুটা পাগলাটে কুমির চাষী মুসতাক আহমেদ, কার্টুনিস্ট কিশোর, সাংবাদিক কাজল এদের জীবনযাপন ও চিন্তা ভাবনা দেখেন তাহলে দেখবেন এরা খুবই সাধারন মানুষ যাদের নিজেদের জীবনটাকেই সঠিক পথে চালানোর জন্য যে ডিটারমিনেশন ও স্ট্র্যাটেজিক ইনটেলিজেন্স প্রয়োজন সেটাও তাদের ঠিকমত ছিল না। থাকলে নিজেরা রাজনৈতিক কর্মী না হয়েও তাসনিম খলিল গংদের সাথে খোলামেলা সরাসরি যোগাযোগ কোনভাবেই রাখত না।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে আশ্চর্য হলো এইরকম কৌশলগত নির্বোধ যারা তাদের নিয়ে মধ্যম আয়ে উন্নিত, সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া থেকে উন্নত ইউরোপ আমেরিকাকে দেশ চালানো শিখিয়ে দেওয়া সরকার তার চৌকষ ও বিশ্বস্ত সামরিক বাহিনী ও কিলার পুলিশ ফোর্স থাকা ও তিনবার একই দলের সরকার গঠন করা একটি রাষ্ট্র এত ভীত কেন যে তারা কার্টুন এঁকে আর ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে সরকার ফেলে দেবে?
কিশোরের কার্টুন তেমন মহা উন্নত কিছু নয় মুসতাকের লেখাও নয়, তাহলে? তাদের একমাত্র দোষ হয়ত সুইডেনে বাস করা তাসনিম খলিল গংদের সাথে যোগাযোগ। কিন্তু তাসনিম খলিলইবা এমন কি। তাকে তৈরী করেছে তো ওয়ান ইলেভেনের সমারিক সরকার সিএনএন এর স্ট্রিংগার ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করার সময়।
উইকিপিডিয়া লিখছে “খলিলকে শহরের ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়নি তার শহর এলাকার সংসদ ভবন সেনা শিবিরে এবং সেখানে দুর্নীতি দমন টাস্কফোর্সের হাতে রাখা হয়েছিল। এই গ্রেপ্তারের সময় তিনি বেশিরভাগ সময় চোখ বন্ধ রেখেছেন এবং তাকে লাটিপেটা করা হয়েছিলো।
তাসনিমখালিল ডটকম-এ তার ব্লগিং সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। ফোরাম ম্যাগাজিনে তার লেখা একটি নিবন্ধের কারণে তাকেও মারধর করা হয়েছিল। তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারবিরোধী এবং গুপ্তচর হিসাবে অন্যান্য দেশে সিএনএন এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাথে কাজ করার অপরাধ স্বীকার করতে বলা হয়েছিল।”
আমরা যদি ঐ ঘটনার ১৪ বছর পর তাসনিম খলিলকে দেখি তাহলেও দেখব এখনও সে এবং তার পত্রিকা, তার লেখা খুবই অ্যামেচার মানের এবং তার সবকিছুই এক ক্ষুব্ধ ব্যক্তির একক প্রচেষ্টা মাত্র। এক্ষেত্রে সময়ে সময়ে সে যাদের সাথে যুক্ত হয় যেমন জামাত বিএনপির লবি গ্রুপ, সেটিও তার মেধা এবং স্ট্রাটেজিক নির্বুদ্ধিতারই প্রমান।
কারন জামাত বিএনপি সরাসরি সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত। তাদের সাথে খোলামেলা যুক্ত হওয়া মানে তার নিজের ক্রেডিবিলিটি হারানো। এটাও খুব আশ্চর্যের যে এই তাসনিম খলিল গং নিয়েও সরকার এক ভীত কেন? তাদের অ্যসেট কি? ক্রেডিবিলিটি কি? ক্ষমতা কি? লেখালেখি আর সাংবাদিকতা, রিপোর্টিং এর বাইরে তারা আর কিছু করে কি?
বিন্দুসম এক শত্রুকে কেন বাংলাদেশের সর্বকালের ক্ষমতাশালী সরকার তাদের সমকক্ষ শত্রু ভাবছে যে তাদের সাথে মেসেজ বিনিময় করলে তাদের ধরে নিযে টর্চার করতে হবে বা তাদের আইন অমান্য করে বিনা বিচারে আটক রেখে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে হবে?
এই বিনা বিচারে আটক রাখার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে জনগনেরই নিরাপত্তার স্বার্থে রচিত ও প্রবর্তিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। পুরো বিষয়টাই কিন্তু গোলমেলে। কেন পিপিলিকাসম শক্তির রাজনৈতিক ও স্ট্যাটেজিক মেধাহীন শধুই লিখা এবং তথ্যশত্রুদের রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর শত্রু বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে সরকার?
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে যদি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে এটা বহু ক্ষেত্রে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক অথবা একে এমন ভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে যা ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার চরমভাবে লংঘিত করতে পারে।
এইরুপ একটি আইন রাষ্ট্রকে চরম ক্ষমতার অধিকারী করে যেটি যে কোন বিরুদ্ধমতকে অঙ্কুরেই দমিত করতে রাষ্ট্রকে সহায়তা করবে। যে কোন আইন তৈরীর আগে এর একটি ইনটেন্ট বা উদ্দেশ্য থাকে। এই আইনের উদ্দেশ্য মানুষকে ডিজিটাল সিকিউরিটি দেওয়া নয়। এর ইনটেন্ট হল রাষ্ট্রের বা সরকারের সামান্য বিরুদ্ধচারণ করছে যে বা যারা তাদের উপর সর্বোচ্চো ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে সমুলে উৎপাটন করা এবং সেই উদাহরণে বাকিদের ভীত করা।
২০০১ সালে যখন আমেরিকায় ৯/১১ হামলা হয় তারপর রাতারাতি সেখানে প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট নামে একটি আইন পাশ হয় যেটি একেবারেই আমাদের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অনুরূপ। এভাবেও বলা যেতে পারে আমেরিকার প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট অনুকরণ করেই আমাদের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট তৈরী হয়েছে।
শুধু তাই নয় বিভিন্ন মিডিয়ায় দাবি করা হয়েছে যে আমাদের কোন আইনপ্রণেতা পাশ হবার আগে এই আইনটি পড়ে দেখেননি বা সংবিধানের সাথে তার সংঘর্ষকে তুলে ধরেননি যেখানে ব্যক্তির অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে যেটা রক্ষায় যিনি নির্বাচিত ও শপথকৃত। একইভাবে আমেরিকায় প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট পাশের আগে আমেরিকার কোন আইনপ্রণেতা সেটা পড়ে দেখেন নি (কংগ্রেসম্যান জিম ম্যাকডরম্যট এর স্বীকারোক্তি, ফারেনহাইট ৯/১১)।
যে আইন পাশের আগে আইনপ্রণেতারা সেটা পড়বেন না এবং যত সংবিধানবিরোধীই হোক সবাই সেটা মেনে নেবে এই ধরণের আইন পাশ করতে গেলে রাষ্ট্র বিপজ্জনক শত্রু দ্বারা আক্রান্ত বা বা প্রচন্ড ক্ষমতাধর শত্রুরা রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত এমন পরিস্থিতি তৈরী করা দরকার।
সেটা এমনভাবে করা দরকার যেন সেই শত্রু আবার আসলে যেন কিছুই করতে না পারে – অর্থাৎ তারা হবে কাগুজে বাঘ। ২০০১ সালে প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট তৈরীর আগে এমনই এক সম্পুর্ণ ভঙ্গুর রাষ্ট্র ইরাক এবং তার সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন ও অক্ষম প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে বেছে নেওয়া হয়।
২০০১ এর সেপ্টেম্বরে ৯/১১ হামলার আগে মে জুন মাসেই আমেরিকার সিআইএ এবং এফবিআই উভযয়েই জানত যে বিমান চালনা প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু সন্দেহজনক কাজকর্ম হচ্ছে। এমনকি ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্টও জানত যে একটি সন্ত্রাসবাদী হামলা আসন্ন। তারা যেন চাচ্ছিল যে এটা হোক।
তাহলে তারা দেশব্যাপী যে মনের শত্রু তৈরী করতে চাচ্ছে সেটা সফল হবে যার উদ্দেশ্যই হল প্যাট্রিয়ট অ্যাক্টের মত নিয়ন্ত্রণমূলক আইন তৈরী করা ও যার লক্ষ্য হল রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সকল সমালোচনা বন্ধ করা ও মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরী করে রাষ্ট্র ও মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরী করা।
যদিও ৯/১১ এর হামলা ইরাক করেনি করেছে করে সৌদি নাগরিক ওসামা বিন লাদেন। ওসামা বিন লাদেন পরিবারের সাথে ব্যক্তিগত ব্যবসা ছিল আমেরিকার ক্ষমতাসীন একাধিক সর্বোচ্চো ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের। এই প্যাট্রিয়ট অ্যাক্টের ভীতি সেসব নিয়ে প্রশ্ন তো দুরের কথা, অন্যায়ভাবে ইরাক আক্রমনের পথ প্রসারিত করে।
রাষ্ট্রের অর্থ হচ্ছে তার নাগরিকের সাথে একটি অলিখিত চুক্তি। যে চুক্তি হয় ঐশ্বরিক সংজ্ঞায় যার মূল ভিত্তি হল স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার। সেই রাষ্ট্র যখন মানুষের হাত থেকে মানবরূপী শয়তানদের হাতে চলে যায় তখন সেই ঐশ্বরিক সংজ্ঞা মুল্যহীন হয়ে যায়।
আমেরিকা রাষ্ট্রটি তৈরী হয়েছিল সেই ঐশ্বরিক সংজ্ঞায়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এটা শয়তানদের হাতে চলে যায়। যত উন্নয়ন আর চাকচিক্যই থাক এটা তার পর থেকে শয়তানের কারখানা। আমেরিকা সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ বাধিয়ে ভিন্ন দেশ লুটপাট করে মানুষ জনপদ ধ্বংশ করে সেই ইভিল স্টেট সচল রাখে।
অনেক আশা নিয়ে শেখ মুজিবও সেই ঐশ্বরিক সংজ্ঞায় পাকিস্তান তৈরীর একজন কারিগর ছিলেন। দ্রুতই পাকিস্তান বিপথে যায় ও পাকিস্তান সেই ঐশ্বরিক সংজ্ঞাসমূহ লঙ্ঘন করে ষাটের দশকে এসে।
আমেরিকাকে অনুকরণ করে তারাও পরিণত হয়েছিল ইভিল স্টেটে। তারা তো আর বিদেশে আগ্রাসনের যুদ্ধ বাধাতে পারেনি, ফলে আগুন জ্বলেছে নিজের দেশেই আর সেটা ভেঙে হয়েছে দুভাগ।আমাদের বাংলাদেশও স্বাধীন হয়েছিল ঐশ্বরিক সংজ্ঞায় যার মূল ভিত্তি ছিল স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার। কিন্তু আমেরিকাকে অনুকরণ করে আমরাও এখন ঐ পথে।
আমাদের পরিণতিও হবে নিজের দেশের শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবতা ধ্বংশ হওয়া। নিজের দেশে আগুন লাগা। এটি পরিহাস যে সেই শেখ মুজিবের দলই আজ সেই ইভিল স্টেটের চালকের আসনে।