বাতেন মোহাম্মদ, লেখক
একটু ঘাটাঘাটি করে দেখলাম — পৃথিবীর বহু দেশ জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করেছে, পরিমার্জন করেছে৷ তাই আমাদের দেশে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আলাপ উঠলে এত সেন্টি খাওয়ার কিছু নাই। এটা ধর্ম গ্রন্থ না যে পরিবর্তন করা যাবে না!
জার্মানী তাদের রিইউনিফিকেশনে মানে ১৯৯০ এ জাতীয় সংগীত পরিমার্জন করেছে। রাশিয়ার অবস্থা আরো ইন্টারেস্টিং। একবার ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেংগে যাওয়ার সময় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করেছিলো কমিউনিজম থেকে গনতান্ত্রিক যাত্রার বাস্তবতায়। কিন্ত সেই সংগীত জনপ্রিয় হয় নাই। তাই আগের জাতীয় সংগীতের সুরে নতুন লিরিক দিয়ে তারা ২০০০ সালে নতুন জাতীয় সংগীত গ্রহন করলো।
দক্ষিন আফ্রিকা তাদের আগের জাতীয় সংগীত পালটে ফেলেছে কারণ সেটাতে এপারথাইট উপাদান ছিলো। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং জাতীয় সংগীত পাল্টানোর ঘটনা সম্ভবত কানাডার। তারা সংগীতের কিছু শব্দে পরিবর্তন এনেছে ২০১৮ সালে যাতে এটা জেন্ডার নিউট্রাল হয়।
ভারতের জাতীয় সংগীতের ইতিহাস জানেন? মোটামুটি সব ঠিক বংকিমের “বন্দে মাতরম” জাতীয় সংগীত হবে। কারণ এই গান ঔপনেবেশিক আমলে জাতীয়তাবাদ জাগরনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলো। তাছাড়া এই গানে জোশ আছে একটা। A R Rahman এর রেন্ডিশন বন্দে মাতরম টা শুনছেন না?? মা তুযে সালাম— বন্দে মাতারম।
শুনলেই একটা জোশ আসে কিন্ত ১৯৫০ সালে ন্যাশনাল এম্বেসলিতে জাতীয় সংগীত হিসাবে ভারত গ্রহণ করলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জন গন মন”। কারণ ইনক্লুসিভিটি, এটা ভারতের নানা এথনিসিটিকে, ডাইভার্সিটিকে এক্সপ্লেইন করে। জাতীয় সংগীত তাই কোন গান কোন আন্দোলনে গুরুত্ব বহন করেছে সেটার উপর নির্ভর করে সাধারণত হয় না।।এটা নির্ভর করে সেই দেশের মানুষ, সংষ্কৃতি, পরিবেশ মানে যার উপর জাতীয়তার পরিচয় নির্মিত হয় সেটাকে রিপ্রেজেন্ট করে–
আমাদের দেশে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আলোচনাকে আমি ইতিবাচক ভাবে দেখি। এই আলোচনা সামনে না আসলে অনেকেই হয়তো এত ক্রিটিকালি চিন্তাও করতো না– আমার সোনার বাংলা গানটার আসলেই প্রয়োজনীতা আছে কিনা? এটা আমাদের জাতীয়তাকে রিপ্রেজেন্ট করে কিনা? তখন যে যার মত নিজেদের যুক্তিকেই সেরা ভাবতো। এই আলোচনা সামনে আসায় আমরা পক্ষ বিপক্ষের যুক্তিগুলো জানতে পারছি।
সত্য বলতে পক্ষের বেশির ভাগই জাতীয় সংগীতকে পবিত্র জ্ঞান করে সেক্রেড টেক্সটের মত দেখছে ( অনেকে ভালো যুক্তিও উপস্থাপন করেছেন)। তুলনামুলক বিপক্ষের যুক্তি গুলো আমার কিছুটা ম্যাটার আছে মনে হইলো।
বিপক্ষের যুক্তিগুলোর মধ্যে প্রধান মত এই গান রবীন্দ্রনাথ বংগভংগের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন ১৯০৫ সালে। তাই এটা কলকাতার আধিপত্যকে রিপ্রেজেন্ট করে। দ্বিতীয় যুক্তি রবীন্দ্রনাথ তো এটাকে জাতীয় সংগীত হিসাবে লিখেনি।।তৃতীয় যুক্তি রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিমকে রিপ্রেজেন্ট করে না।
দেখি যুক্তিগুলোর রেশনালিটি।
প্রথমত, যে বাস্তবতায় বংগ ভাগ হয়েছিলো ১৯০৫ সালে তা আমাদের বর্তমান বাস্তবতার পলিটিকাল এরেঞ্জমেন্ট এর সাথে সম্পর্কিত না। ব্রিটিশরা তাদের শাসনের সুবিধার্থে ভাগ করেছিলো। তাই সেই সময়ে যারা ভাগের বিরোধিতা করেছিলো তাদের প্রধান কনসার্ন ছিলো এটা কলোনিয়াল ডিভাইডেশন এন্ড রুল এপ্রোচ।
এখন যদি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের শাসন ব্যবস্থা থেকে আলাদা করে দেয়া হয়, আপনি যে ভৌগলিক অখন্ডতার দাবী তুলবেন বংগভংগের বিপরীতের দাবীগুলো ও অনেকটা তাই। তবে এর মধ্যে আঞ্চলিক আধিপত্যের চিন্তা থাকতেই পারে, এতদিন একসাথে থাকার অভ্যস্থতা থাকতে পারে, কলোনিয়ালদের দুরভিসন্ধির প্রতি সতর্কতা থাকতে পারে। তাই কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথ এর বিরোধিতা করেছিলেন সেটাকে টেনে এনে বর্তমানের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সাথে মেলানো অত্যন্ত হাস্যকর যুক্তি।
কারণ সেই সময় পাকিস্তান আন্দোলন ও শুরু হয়নি। তাই পূর্ব পাকিস্তান এবং পরে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও স্বাধীনতার রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রশ্নতো আসে না।
পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাই হয়েছিলো ১৯০৬ সালে ( ঢাকায়)। বিস্তারিত সেইসব আলোচনায় গেলাম না ( যদিও কিছু ঐতিহাসিক মুসলীম লিগের প্রতিষ্ঠার সাথে বংগ ভংগের একটা সংযোগ দেখেন)।
তবে এইটা বলার মুল পয়েন্ট হচ্ছে বংগভংগ এর যে বাস্তবতা সেটার সাথে বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন তাই সেই সময়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের গান/ কবিতাকে এন্টি বাংলাদেশ বলাটাই শুধু হাস্যকর যুক্তি না, এটা কোন যুক্তির মধ্যেই পড়ে না।
দ্বিতীয় যুক্তি রবীন্দ্রনাথ জাতীয় সংগীত হিসাবে লিখেনি। রবীন্দ্রনাথ জাতীয় সংগীত হিসাবে লিখবে কেন? রবীন্দ্রনাথ তো ১৯৪১ সালেই মারা গেছেন। মানে উনিতো ভারত পাকিস্তান ভাগ ও দেখে যেতে পারেনি। আর বাংলা যে স্বাধীন হবে সেটা উনি কিভাবে জানবেন? উনি ভারত যে স্বাধীন হবে সেটাইতো জানতেন না।।
বরং আমাদের দেশ স্বাধীনের পর এই গানের মর্মার্থ অনুধাবন করে একে দেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহণ করেছি। এটা আমাদের এডপশন। রবীন্দ্রনাথের এখানে কিছু করার নাই।
তৃতীয় যুক্তি এতটাই হাস্যকর যে সেটা নিয়ে কিছু লেখাই আমার সময় নষ্ট। এই হাস্যকর হিন্দু কবি, মুসলিম কবি– রবীন্দ্রনাথ- নজরুল দ্বৈরথ যে কি পরিমান মাথামোটা বিতর্ক – সেটা বুদ্ধিবৃত্তির কতটা নিম্ন স্তরে অপারেট করলে করা যায় সেটাই ভাবছি। তাই এই পয়েন্ট নিয়ে আমার যুক্তি দিলাম না।
চ্যাট জিপিটিকে জিজ্ঞেস করলাম কোন কোন কারণে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হয়। সে পৃথিবীর নানা দেশের ইতিহাস ঘেটে যে সামারি আমাকে দেখালো সেটা এইরকম–
কলোনিয়াল শাসনের অবসান। দেশ স্বাধীন হলে। বিপ্লব পরবর্তী অবস্থায় আগের শাসনামলের সময় গৃহীত হলে।
আমাদের জাতীয় সংগীত গত পনের বছর যে আওয়ামী শাসন যার বিরুদ্ধে গন অভ্যুত্থান হয়েছে তাদের সময়ে গৃহীত না।।তাই ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য হিসাবে এটাকে পরিবর্তনের আলোচনা খুব বেশি যুক্তিযুক্ত না। দেশ স্বাধীন হলে নতুন জাতীয় সংগীত গ্রহন করা হয়। আমার সোনার বাংলা তো তাই করা হয়েছে।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের প্রেক্ষাপটে। এখন আপনি যদি সেই স্বাধীনতাই অস্বীকার করেন তাহলে এই জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আলোচনা আপনার কাছে হয়তো মনে হতে পারে ক্রিটিকাল ডিমান্ড কিন্ত আসলে অন্তসারশূন্য।
আরেকটা যুক্তি দেখলাম– এই সংগীতে মানুষের কথা নাই।।সংগ্রামের কথা নাই। আগেই উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছি কেন বন্দে মাতরমে জোশ থাকার পরেও, কেন স্বদেশী আন্দোলনে ব্যাপক ভুমিকা থাকার পরেও ভারতের জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহন করা হয় নাই।
জাতীয় সংগীত সাধারণত ইনক্লুসিভিটি, ইউনিক জিয়োগ্রাফিক আইডেন্টিটি, কালচারাল ডিস্টিংটিভনেস কে এড্রেস করা হয়- যেটা টাইম লেস।।আন্দোলন একটা চলমান ইভেন্ট। একেকটা আন্দোলন একেকটা রুলকে ডিফাইন করবে। সেটা জাতীয় সংগীতের যে টাইমলেস আবেদন সেটাকে রিপ্রেজেন্ট করে কিনা- সেই প্রশ্ন আছে। কয়েকটা জাতীয় সংগীত পড়ে দেখেন।।
সেগুলোর প্যাটার্ন দেখেন। এমনকি ভারতের উদাহরণ মনোপুত না হলে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত পড়ে দেখেন– সেখানেও মুলত পাকিস্তানের দেশ হিসাবে জয়গান গাওয়া হয়েছে।।পাকিস্তান কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে সেই আন্দোলন সংগ্রামের বর্ননা না সেই সংগীত।
আমার সোনার বাংলার মত করে আর কোন গান বাংলার প্রান প্রকৃতি, ঋতু বৈচিত্র্য কে ধারণ করেছে? দেশপ্রেমকে ধারণ করেছে? যখন আপনি বলবেন– আমার সোনার বাংলা- আমি তোমায় ভালোবাসি।। প্রথম লাইনেই তো এক নিখাদ ভালোবাসা, এক প্রেমের উপাখ্যান। চিরদিন তোমার আকাশ- তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি– এই যে টাইমলেস ব্যাপারটা — জাতীয়তাবোধের টেম্পোরাল স্কেল এর যে লিগেসি পার্ট- সেটা এইরকম শক্তিশালী ভাবে আর কোন গানে আছে, দেখান তো?
যারা বলে এই গানে মানুষের কথা নাই তারা সম্ভবত মানুষকে ধর্ম কিংবা এথনিসিটির ন্যারো ফোকাসের বাহিরে চিন্তাই করতে পারেনি। কারণ প্রথম শব্দই যখন বলি- “আমার” এটাই তো কালেকটিভ আইডেন্টি।।এটাইতো আমরা সবাই। এটাইতো এই ভূখন্ডের জনগনের সার্বজনীনতা।
এরমধ্যে ধর্ম, বর্ন, ভেদাভেদ নাই। এই আমার শব্দটার মত “মানুষ” কে রিপ্রেজেন্ট করার আবার একই সাথে একটা জাতিগত বাউন্ডারি ( আমার মানে আমার দেশের মানুষ, অন্য দেশের না) দূটোই আছে। সবচেয়ে বড় কথা এই গান ব্যক্তি বন্দনা নির্ভর না।।এই গান ধর্মীয় ন্যারো বাউন্ডারীকে স্পর্শ করেনি। এই গান শুধুই দেশ ও দেশের বন্দনা।
আমাদের জাতীয় সংগীত হিসাবে এটাকে গ্রহন করা হয়েছে এই গানের /কবিতার যে সার্বজনীন আবেদন, এর মধ্যে দেশের প্রকৃতি, মাটি, পানি, বায়ু, পরিবেশ, জীবন- এইসব উপাদানের যে আন্তসম্পর্ক ও টাইমলেস মিথস্ক্রিয়া সেটার প্রেক্ষিতে। এটা রবীন্দ্রনাথ লিখেছে, কিংবা কোন প্রেক্ষাপটে লিখেছে সেই রাজনৈতিক চিন্তায় জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহণ করা হয়নি।
এবং সেই রাজনীতি ৭১ এর বাস্তবতায় প্রাসংগিক ও ছিলো না। স্বাধীন দেশে জাতীয় সংগীত সেই দেশকে রিপ্রেজেন্ট করে, জাতীয়তাবোধকে একটা জায়গায় নিয়ে আসে। আমার সোনার বাংলার মত করে আর কোন গান এমন আবেদন তৈরি করেছে- আমি জানি না।
জাতীয় সংগীত বদলের যুক্তিগুলো বেশির ভাগই ঠুনকো।।ন্যারো রাজনৈতিক বিরোধিতা ও খন্ডিত ইতিহাস পাঠ ও স্বাধীনতার যুদ্ধে পরাজিত শক্তি যে ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলো তার দ্বারা অনুপ্রাণিত। এইগুলোর মধ্যে আমি সারবত্তা খুজে পাইনি।।