নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ও আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছরই ছোট বড় বন্যায় আক্রান্ত হয়। দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সময় সময়ে বন্যার মাত্রা ও স্থায়িত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়ায় এর ক্ষয়ক্ষতিও দিন দিন বেড়েই চলছে। তবে, এই বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তার বিপরীতে ব্যবস্থাপনা কতটুকু সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে এই প্রতিবেদনে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৃষ্ট বন্যা চাপ ফেলছে দেশের অর্থনীতিতে। খাদ্য উৎপাদন কমার পাশাপাশি, মন্থর হচ্ছে দারিদ্র বিমোচনের গতিও। তবে, এর বিপরীতে রাষ্ট্রের যে ব্যবস্থাপনা তাতেও আশানুরূপ প্রতিকার মিলছে না ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের। এমন অবস্থায় সমন্বিত ও যুগোপযোগী ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা দরকার বলছেন বিশ্লেষকরা।
চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ে তিন দফায় বন্যার কবলে পড়েছে সিলেটে। এখনও যা চলমান। যাতে বিভাগের চার জেলার অন্তত ২৫ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
পরিসংখ্যান বলছে, সিলেটে ১৯৮৮ সালের পর বন্যা ছিল ২০০৪ সালে। তারপর ধারাবাহিকভাবে এই ২০ বছরে ছোট বড় ১০টি বন্যা মোকাবিলা করেছে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের মানুষ। প্লাবন ভূমির মানুষের যখন বন্যা সঙ্গী তখন বন্যা ব্যবস্থাপনায় কৌশল মূলত বাঁধ নির্মাণ। প্রতি বছর বাঁধ দিয়েও বন্যার পানি ঠেকানো কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে প্রকৃতির ওপর কোনো হাত যেখানে থাকে না, চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি বেশি হবে কি না, উজানের পানি কতটুকু নামবে জানা কি সম্ভব? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা জরুরি। এছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় গবেষণা ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের তাগিদ দেন তারা।
কৃষি ডায়েরির তথ্য মতে, ১ লাখ ৪৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবনভূমি। বন্যার কারণে পলি পড়ে এসব জমি ক্রমশ উঁচু হচ্ছে। যা ব্যাহত করছে প্রান্তিক জনপদের স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা। এমনই একটি অঞ্চল রংপুর।
দেশের চতুর্থ বৃহৎ আর বহুরূপী তিস্তা গেলো তিন দশকে ক্রমেই যেনো অবাধ্য আর বেয়াড়া হয়েছে। মৌসুমভেদে তার পরিবর্তিত রূপ বিপাকে ফেলছে স্থানীয়দের। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা পানিশূণ্য কঙ্কাল আর বর্ষায় উজানের ঢলে প্লাবনের রেকর্ড হয় প্রতিনিয়ত। এই এক নদীতেই বিপর্যস্ত হচ্ছে উত্তরের প্রতিটি জনপদ ।
১০টিরও বেশি নদ-নদী রংপুর বিভাগের প্রায় দুই কোটি মানুষের আশীর্বাদ ছিল। পরিচর্যা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে নদীগুলো এখন বয়ে আনে অভিশাপ। রক্ষণাবেক্ষণের উদাসীনতা নদীগুলোকে করে তুলছে মুমূর্ষু। মৃতপ্রায় অনেক নদীর কারণে বাধাগ্রস্ত জলের অর্থনীতি।
অঞ্চলভিত্তিক বন্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পাহাড়ি ঢল, প্লাবন ভূমি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, শহরাঞ্চল আর উপকূলের বন্যার ধরণ ভিন্ন হলেও প্রতিকার বা প্রতিরোধে অনুসরণ করা হয় একই ব্যবস্থাপনা। বন্যা ব্যবস্থাপনায় আসলে কী হচ্ছে?
প্রতি বছর বর্ষায় দেশের এক তৃতীয়াংশ জেলাই ডুবে যায় বানের পানিতে। কখনও ক্ষণস্থায়ী আবার কখনো দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় তলিয়ে যায় ফসলের মাঠ বাড়িঘর। বাস্তুচ্যুত হয় লাখ লাখ মানুষ। নেমে আসে দুর্ভোগ। কিন্তু, তা লাঘবে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা কতটুকু কার্যকর?
১৯৫৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সৃষ্ট বন্যা বিশ্লেষণে দেখা যায় ক্রমে বাড়ছে বন্যাপীড়িত এলাকা। ২৫ থেকে বেড়ে এখন আক্রান্ত এলাকা ৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একইসাথে অর্ধশত বছরে বেড়েছে বন্যা ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও। তবে, এসব ব্যয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পর তদারকির অভাবকেই দায়ি করছেন বিশেষজ্ঞরা। বলছেন, অনুদাননির্ভর ব্যবস্থাপনা থেকে বের হয়ে প্রযুক্তিভিত্তিক সময়োপযোগী প্রকল্প বাস্তবায়নই কেবল মজবুত করতে পারে বন্যা ব্যবস্থাপনা।

previous post
next post