শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৫, ৬ ও ৭ আগস্ট বরিশালের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। সংখ্যালঘুদের বাসস্থানে হামলা ছাড়াও মন্দির ভাঙচুরের অভিযোগও রয়েছে। ভিটেমাটি ছাড়তে অনেককে দেয়া হয় হত্যার হুমকিও।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানায়, পিরোজপুর জেলা সদরের গোপালপুর রায়ে হিন্দুদের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ ছাড়া কালীবাড়ি, মঠবাড়িয়া হরিচাঁদ ঠাকুর মন্দির সংলগ্ন সংগাতি ইউনিয়নের বড় ব্রিজ উচ্চ বিদ্যালয়, নাজিরপুরের শ্রীরামকাঠি বাজারে সংখ্যালঘুদের দোকান ও ইন্দুরকানীতে সংখ্যালঘুদের অন্তত ২০টি বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়।
বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার মাহিলারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে এবং বানারীপাড়া উপজেলার কুন্ডা পাড়ায় সুব্রত কুন্ডু ও মন্টু কুন্ডুর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা।
ঝালকাঠি সদরে সাংবাদিক দুলাল সাহার বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। এ ছাড়া কাঁথালিয়া থানার বাশবাড়িয়া গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অবিনাশ চন্দ্র সান্যালের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় রাধাগোবিন্দ মন্দির ও কয়েকটি বাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুরঞ্জিত দত্ত লিটু বলেন, ‘আমাদের সংগঠন থেকে প্রাথমিকভাবে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে। তবে বরিশাল অঞ্চলে আরও অনেক হামলার ঘটনা ঘটেছে। ঘর ছাড়া রয়েছে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী।’
এমনকি ফরিদপুর ইউনিয়নের গাজীতলা বাজার সংলগ্ন এলাকাবাসীর বাড়িতে দুবার হামলা ও লুটপাট করা হয়েছে। বাড়ির মন্দিরও ভেঙে ফেলা হয়। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ৭ জন।
তারা বলেন, ‘দরজার তালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে এক থেকে দেড়শ লোক। মন্দির ও বাড়ি থেকে লুট করা হয় ১৫ ভরি স্বর্ণ ও নগদ ৮ লাখ টাকা। নিয়ে গেছে জমির দলিলও। আমরা সবাই এখন গৃহহীন।’
ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশায় গত ৫ আগস্ট বিকেলে স্থানীয় একের বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। মালামাল নেওয়ার পাশাপাশি তারা প্রকাশ্যে হাটে একটি ছাগল ও দুটি গরু জবাই করে রান্না করে খায় তারা।
উপজেলার ভিমরুলী ইউনিয়ন বাজারে শেখ রাসেল পাঠাগার ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় তারা গ্রন্থাগার সংলগ্ন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির একটি চায়ের দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট সিগারেট ও আরেকটি চায়ের দোকান লুটপাট করে নগদ ৩৬ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।
এদিকে পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠিতে হামলার শিকার নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, জমি নিয়ে স্থানীয় একটি গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলছিল। ৫ আগস্ট বিকেলে ওই গ্রুপের লোকজন একত্রিত হয়ে হামলা চালায়। বাড়িঘর ভাংচুর ও স্বর্ণ ও নগদ টাকা লুট করা হয়।
পিরোজপুর উপজেলা সদরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের হুমকি দেয়া হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কথা বলতে চাই না। তবে আমাদের বাড়িতে কোন হামলার ঘটনা ঘটেনি।’
ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়নের গোলকপুর গ্রামের মারধরের শিকার এক যুবক বলেন, ‘এলাকায় একটি জমি নিয়ে একটি পক্ষের সঙ্গে বিরোধ ছিল। ঘটনার দিন আমাদের ১২ জনকে খাসেরহাট বাজারে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর করে এবং কানে ধরে উঠবস করায় ওই পক্ষের লোকজন।’
বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের এক বাসিন্দা বলেন, পরিস্থিতি পাল্টে গেলে রাতে আমাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়। যারা এই কাজ করেছে তারা আমাদের পরিচিত। সরকারের পতনের খবর পাওয়া মাত্রই তারা আমাদের বাড়ি ভাংচুর করে।
পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির শান্তিহার গ্রামে গত ৬ আগস্ট রাতে একটি হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়। ভুক্তভোগীরা জানান, বাড়ির চারজনের মধ্যে তিনজনকে বেঁধে মারধর করা হয়, একজন পালিয়ে যায়। লুট হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। সবাইকে অত্যাচার করে সারারাত অচেতন অবস্থায় ফেলে রাখা হয়।
বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার ইলুহার ইউনিয়নে এক গৃহকর্তাকে মারধর করে তিন লাখ টাকা ও দুই ভরি স্বর্ণালঙ্কার ছিনতাই করা হয়। প্রাণনাশের হুমকিতে তাদের দেশ ছাড়তে বলা হয়। পরিবারের সদস্যরা ভয়ে মুখ খুলতে রাজি না হলেও তারা এই গ্রামে আর থাকবেন না বলে জানান।
গত ৫ আগস্ট রাতে একই উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নে একটি হিন্দু বাড়িতে ডাকাতি হয়। উপজেলার এক সংখ্যালঘু নেতা জানান, সৈয়দকাঠি ইউনিয়নে নিপীড়ন থেকে বাঁচতে রাতভর একটি বাড়ির ৯ নারী পুকুরে নেমেছে। বাড়িতে কাউকে না পেয়ে আসবাবপত্র ও টাকা লুট করে নিয়ে যায়।
বরিশাল নিপীড়ন বিরোধী ফোরামের সমন্বয়ক কাজল দাস বলেন, “বরিশাল শহরে হিন্দু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও দখলের চেষ্টা করা হয়। এমন ঘটনা ঘটেছে বাজার রোডের মহাদেব ভান্ডার ও চকবাজারের দেবনাথ বস্ত্রালয়ে। বরিশালের হিন্দুরা সারারাত ভয়ে ঘুমাতে পারছে না, আমরা স্বৈরাচারের পতনের পর মৌলবাদের উত্থান দেখতে চাই না।’
বরিশালের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব এলবার্ট রিপন বল্লভ বলেন, “আমরা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কথা বলেছি। বেশ কয়েকটি জায়গায় হামলার প্রমাণও পেয়েছি।
বাংলাদেশ হিন্দু পরিষদের বরিশাল বিভাগীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক গৌতম রায় বলেন, “সরকার পরিবর্তন হলেই প্রথমে হিন্দুদের ওপর হামলা হয়। ছাত্র আন্দোলনে সরকার পতনের পরপরই বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের ওপর হামলা হয়।
previous post