সিরাজুল হোসেন, লেখক
২০২১ সালে আমি একটি সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে পদত্যাগ করি। পদত্যাগের কারণ ছিল বোর্ডরুম রাজনীতি। ২০১৭ সালে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্রান্তিকালে যখন সেটি নানা সমস্যায় ভুগছে এবং ডুবন্ত প্রায়, তখন আমি সেটার দায়িত্ব নেই প্রধানত একটি প্রতিষ্ঠান ও তার শতাধিক কর্মীকে রক্ষার জন্য।
আমি দায়িত্ব গ্রহণের সময় আমাকে পরামর্শ দেওয়া হয় আগের সিনিয়র ম্যানেজারদের বিদায় করে দিয়ে কাজ করতে। আমার কাছে মনে হয় এটা আগে করার চেয়ে দক্ষ লিডারশিপের মাধ্যমে টিমটাকে মোটিভেটেড করার চেষ্টা করা দরকার।
আমি এরপর অল্প সময়েই নিয়মিত মেন্টরিং করে আগের টপ ম্যানেজমেন্ট ও কর্মীদের কয়েকটি দক্ষ ও মোটিভেটেড টিমে পরিণত করতে পারি যার ফলে প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত উন্নতি করে। এর পর হানা দেয় কোভিড।
কোভিডের সময়ও কর্মীদের প্রতি গাইডেন্স এ মেন্টরিং কয়কগুন বাড়িয়ে টিমের মনোবল অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব হয় এবং প্রতিষ্ঠান বা কর্মীদের তেমন ক্ষতি না করেই আমরা সেই বিপদ থেকে বের হয়ে আসি।
এই পুরো সময়টা ছিল একটি ইতিবাচক সময় যখন দুটো চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করে প্রতিষ্ঠানটিকে আমরা স্টেবল ও শক্তিশালী করি। আমাদের নামও তখন ছড়িয়ে পড়ে নতুন করে একটি উদ্ভাবনী ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসাবে।
কিন্তু বাংলাদেশে যা হয়। এই উন্নতি চক্ষুশূল হয় বোর্ডের কারো কারো। আমার টিম সম্পর্কে মন্দ ও অপমানকর কথা বলা হতে থাকে যে বোর্ডরুম পর্যন্ত আসে। টিমের দুর্নাম মানে আমারও দুর্নাম এবং তার প্রতিবাদে আমি পদ ছেড়ে দেই। আমার মনে হয় সুবিধাবাদীদের কথা শুনে প্রতিষ্ঠানের দুঃসময়ে টিমের দেওয়া শ্রম ও প্রতিদান যারা চোখে দেখতে পাচ্ছে না তাদের সাথে কাজ করা বিপজ্জনক। আমার ধারণা ছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমার অবদানটাকে নিশ্চয়ই সম্মান করা হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের আত্মবিশ্বাস, আত্ম মূল্যায়ন ও নীতিবোধ এত কম এবং তাদের মনে লোভ আর ক্ষোভ এত বেশী যে কোন পরিবর্তন হলে তারা ভাবতে থাকে অতীতে যিনি ছিলেন তিনি আমাকে যথেষ্ট মূল্য দেন নাই। নতুন যিনি এসেছেন তার আরো কাছাকাছি যদি যেতে পারি, নিজেকে তার একান্ত গোলাম প্রমাণ করতে পারি তাহলে আমিও তার ডান হাত হব।
নতুন যিনি আসেন তিনি সব সময় ভয়ে থাকেন, তিনি যদি আগের জনের চেয়ে খারাপ ফল করেন? এই দুই মানসিকতা থেকে চলে যাওয়া ব্যক্তিকে হেয় করা বা তার দুর্নাম কারাকে উভয় পক্ষই লাভজনক মনে করে।
এভাবে উভয়েই উভয়কে সত্য লুকিয়ে ভ্রান্ত তথ্য ও প্রতিশ্রুতি দেয় নিজ নিজ অবস্থান পাকা করার আশায়। আগের ব্যক্তি চলে যাবার ফলে যে বিশাল গ্যাপ তৈরি হয় সেটা উভয়েই ঢেকে রাখে।
কিন্তু বাস্তবে এটাকেতো বেশী দিন ঢেকে রাখা যায় না। তখন উপরের থেকে একজন করে ছাঁটাই হয়, পরের জন একই ভাবে আগের জনের যায়গা নেবার জন্য একই রকম তাঁবেদারী করে ভ্রান্ত তথ্য ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজ নিজ অবস্থান পাকা করার আশায়। এই চক্র চলতে থাকে এবং ক্রমেই ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ হয় এবং পরিশেষে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়।
ঠিক এমনই ঘটেছে বাংলাদেশের সবগুলো সামরিক ক্যু বা তত্তাবধায়ক সরকারের বেলায়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে অলস ভবঘুরে পর্যন্ত সবার একই মানসিকতা। আগের জনের মত মন্দ নষ্ট আর কেউ ছিল না, আর নতুন জনের মত এত আদর্শ আর কেউ হতে পারে না।
আত্মবিশ্বাস, আত্ম মূল্যায়ন ও নীতিবোধের অভাব এবং মনে থাকা অসম্ভব লোভ আর ক্ষোভ থেকে সবাই নিজেকে নতুন ক্ষমতার একান্ত গোলাম প্রমাণ করার কাজে নেমে পড়েন। এতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয় প্রতিষ্ঠানটির আর তার সংস্কৃতির। এবারের অবৈধ অর্ন্তবর্তী সরকারে এটা দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশী।
এর কারণ নেতৃত্বহীনতা এবং শৃঙ্খলার অভাব। যারাই এই সরকারের সাথে জড়িত হবে, তারা জাতির শত্রু হিসাবে চিরদিনের জন্য নাম লেখাবেন এটাই আমার ধারণা।