তুহিন খান, লেখক
জুলাই রেভ্যুলুশন কি নির্ধারিত কোনো ছকে আঁকা আন্দোলন ছিল? কোনো একক মতাদর্শের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভজাত বিষয় ছিল? এর সহজ উত্তর: না।
এই আন্দোলন শুরু হয় কোটা সংস্কারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ থেকে। এবং তখন অলমোস্ট কেউই ভাবে নাই যে এটা এক দফার দিকে যাবে। জুলাই রেভ্যুলুশন সাক্সেসফুল হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ২ টা:
১. বিশেষ কোনো ‘বিপ্লবী ইশতেহার’ বা ‘মতাদর্শিক মাস্টারপ্ল্যান’র অনুপস্থিতি। যদি সেরকম কিছু থাকতো, তাইলে এই অভ্যুত্থানে পাবলিক পার্টিসিপেশন এত ব্যাপক হইত না।
২. ম্যাসিভ ম্যাসাকারজাত গণরোষ ও দীর্ঘদিনের লালিত গণআকাঙ্ক্ষার তীব্র বিস্ফোরণ।
যখন কার্ফ্যু জারি হইল, তখন যাত্রাবাড়ির ছাত্র-জনতা কিন্তু কারুর নির্দেশনা মেনে রাস্তায় থাকে নাই। কার্ফ্যুর পর কিন্তু সমন্বয়করা ৮ দফা আর ৯ দফা নিয়া দীর্ঘদিন ডিলেমায় ভুগছেন, কোনটারে ঔন করবেন এই মর্মে।
পরবর্তীতে গণআকাঙ্ক্ষাই ৯ দফারে মেইনস্ট্রিম করে তুলছিল। এমনকি ছাত্র-জনতা ১ দফা ঘোষণা করছিল সমন্বয়কদের একদিন আগেই।
২ আগস্ট শুক্রবার সারাদেশের সর্বত্র ১ দফার ঘোষণা শুরু হয়ে যায়। সেদিন প্রেসক্লাব থেকে শহিদ মিনারের দ্রোহযাত্রায় যে মানুশের ঢল নামে, সেই ঢলই ঢাবির কার্ফ্যু পরিস্থিতিটারে নাই করে ফ্যালে।
ওই ঢল মূলত গণ-আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ছিল। স্যালুট দেওয়া যে রিকশাওয়ালার ছবি এই অভ্যুত্থানের একটা সিম্বল হয়ে উঠছে, সেটা ওই দ্রোহযাত্রা থেকেই তোলা হইছিল।
ফলত চাকরিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া এই আন্দোলন মূলত কোনো একরৈখিক বা পরিকল্পিত ছক মাইনা আগায় নাই। কোনো একক মতাদর্শ বা ব্রেইন এই আন্দোলনের জন্ম দেয় নাই।
বরং এই আন্দোলনটারে ইনিশিয়েট করছে একটা নতুন ‘ভাষা ও চিন্তাব্যবস্থা’, যা গত ১০ বছর যাবত আরবান এরিয়ায়, প্রধানত ক্যাম্পাসগুলাতে ও সোশাল মিডিয়ায়, তৈরি হইছে। এবং এই পরিস্থিতি তৈরিতে অবদান রাখছেন অসংখ্য মাথা ও মনন। অসংখ্য ফর্ম ও কন্টেন্ট। অসংখ্য সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অ্যাক্টিভিজম ও মিথস্ক্রিয়া।
ফলে বলা যায় যে, এই আন্দোলনে কোনো ব্যক্তি না, বরং ওই নতুন ‘ভাষা, চিন্তা ও চিহ্নব্যবস্থা’টিই ছিল প্রধান নিয়ামক। এই রেভ্যুলুশনরে কোনো একজন ব্যক্তি বা তার ব্যক্তিগত চিন্তার উৎপাদন ভাবলে, এই অভ্যুত্থানের মেইন অ্যাসেন্সটাই আমরা মিস করব।
নুরের হাত ধইরা আওয়ামি আমলেই তৈরি হওয়া ‘পোস্ট-ইডিওলজিকাল’ রাজনীতিব্যবস্থা, যা মূলত অধিকারভিত্তিক রাজনীতিতেই নিজেরে সীমিত করে রাখছিল, তা গণআকাঙ্ক্ষার ভেতরে হজম হয়েই এই অভ্যুত্থানে পরিণত হইছে।
২।
ঢাবিসহ সারাদেশের ভার্সিটিগুলায় যখন একজন শিক্ষকও ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়ানোর মত ছিল না, ঠিক সেই মুহূর্তে শিক্ষক নেটওয়ার্ক ছাত্রদের পাশে দাঁড়ায়। ১৭ জুলাই ক্যাম্পাস বন্ধের বিরুদ্ধে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজ’র নামে যে প্রথম প্রোগ্রাম হয়, তার নেতৃত্বে ছিল শিক্ষক নেটওয়ার্কের কুশীলবরা।
কার্ফ্যু শিথিল হওয়ার পর সারাদেশের ছাত্ররা যখন কিছুটা বিহ্বল, পুলিশ, র্যাব ও আর্মির হামলার ভয়ে দিশাহারা, তখন আবারও দৃশ্যপটে আসে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। ঢাবিতে, জাবিতে, রাবিতে, চবিতে তারা পরম সাহসের সাথে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায়। শিক্ষক নেটওয়ার্কের ছত্রছায়াতেই তখন ক্যাম্পাসগুলাতে আবার দানা বাঁইধা ওঠে ছাত্রদের আন্দোলন।
কিন্তু এখন এসে দেখতেছি, শিক্ষক নেটওয়ার্ককে প্রশবিদ্ধ করা হইতেছে৷ সেসময় শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রোগ্রামের ছবিতে যেসব পোলাপান লাভ রিএক্ট দিত, এখন দেখতেছি তাদেরই একদল শিক্ষক নেটওয়ার্করে ‘বাম’, ‘শাহাবাগি’ ইত্যাদি বলতেছে। অনেকে আবার এই শিক্ষক নেটওয়ার্ক ‘ভেঙে ফেলা’র আওয়াজও তুলছেন! হাউ ফানি!
শিক্ষক নেটওয়ার্ক যে এই আন্দোলনের স্টেকহোল্ডার, শহিদ মিনারের দ্রোহযাত্রা যে এই অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান একটা ঘটনা, কার্ফ্যুর সময় হাসনাত-সারজিসের ৮ দফার বিপরীতে আব্দুল কাদেরের ৯ দফাই যে আন্দোলনটারে বাঁচায়ে দিছিল, যাত্রাবাড়ির ছাত্র-জনতা যে কার্ফ্যু না মাইনা কোনো মাস্টারপ্ল্যান ছাড়াই রাস্তায় পইড়া ছিল— এগুলারে খুব সিস্টেমেটিক্যালি এখন অস্বীকার করা হইতেছে।
অ্যাসেমেট্রিক, বিশেষ কোনো ইডিওলজিহীন এই স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনরে এখন একটা ছদ্ম-ইডিওলজির মুখোশ পরায়ে, এর স্কোপ ও স্টেক সীমিত করে ফেলা হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর এই অভ্যুত্থানের ন্যারেটিভ নির্মাণ একটা সরকারপক্ষীয় ও ক্ষমতাসম্পর্কের সাথে যুক্ত বিষয় হয়ে দাঁড়াইছে যেনবা।
যদিও সেই সরকার মোটেই বিপ্লবী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে না। অথচ তার সামগ্রিক আচরণ ও উচ্চারণ বিপ্লবী সরকারের মতই নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম ধরনের। এ পরিস্থিতি অস্বস্তিকর।
৩।
এই পরিস্থিতিটাই মূলত কোনো একটা অভ্যুত্থানের বহুমাত্রিক ও সামগ্রিক ন্যারেটিভ, স্পিরিট ও ইতিহাস নির্মাণের পথে ইমিডিয়েট ও প্রধানতম সঙ্কট। মুক্তিযুদ্ধের পরেও ঠিক তাই হইছিল।
বঙ্গবন্ধু আর আ. লীগের তলে চাপা পড়ে গেছিল মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক বয়ান, ভাষ্য ও ইতিহাস। তৈরি হইছিল সেই যুদ্ধের বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীন এক অলীক ও ফাঁপা চেতনা। অদ্ভুত ইডিওলজি।
মাঠের যোদ্ধাদের অনেকেই হয়ে গেছেন রাজাকার; আর মাঠ দখল করে নিছেন অপরিচিত, অচেনা, সংগ্রামের সাথে সম্পর্কহীন, এমনকি পাকিস্তান সরকারের দালাল অসংখ্য মুখ। জাতির যে সন্তানেরা তখন ওই পরিস্থিতিটারে খোলাশা করতে চাইছেন, তাদের থামায়ে দেওয়া হইছে।
বাঙলাদেশ আবারো সেই সঙ্কটে পইড়া গেলে মুশকিল। দেখা যাবে, এমন এমন সব শব্দ, প্রকল্প ও এজেন্ডা এই অভ্যুত্থানের স্পিরিটের নামে অ্যাডপ্ট করা হচ্ছে, যা আদতে এই অভ্যুত্থানের স্পিরিটবিরোধী।
আবার এই অভ্যুত্থানের যে গণআকাঙ্ক্ষাটা ছিল— সকলের গণতান্ত্রিক অধিকার, একটা গণতান্ত্রিক ও এজমালি রাষ্ট্রের স্বপ্ন— নানাবিধ নয়া ‘চেতনা’, প্রকল্প ও পরিভাষা নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়া দেখা যাবে ওই স্বপ্নটাই নাই হয়ে গেছে। আর বাস্তব রাজনীতির মাঠে আবারো ফিরা আসছে ফ্যাসিবাদ, ১/১১ কিংবা আরো বিপজ্জনক কোনো ঘটনা।
তেমনটা না ঘটুক, বাঙলাদেশে সুষ্ঠু ও সৃজনশীল রূপান্তরের সম্ভাবনাময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হউক, এই কামনা করি।