সিরাজুল হোসেন, লেখক
আধুনিক মিয়ানমারের জাতির জনক অং সান এবং খিন চী এর কন্যা সু চি এর জন্ম হয় ব্রিটিশ বার্মার রেঙ্গুনে। ১৯৬৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৬৮-তে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক অর্জন করার পর তিনি জাতিসংঘে তিন বছর কাজ করেন।
১৯৭২ সালে জনৈক মাইকেল অ্যারিসকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুই ছেলে হয়। ১৯৮৮-র গণ আন্দোলনের সময় সুচি সবার নজর কাড়েন এবং ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৯০ সালের নির্বাচনে এনএলডি সংসদের ৮১% আসন পেলেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায় যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হৈ চৈ ফেলে দেয়। এর পরই সু চিকে নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেওয়া হয়।
সু চির দল ২০১০ সালের নির্বাচন বয়কট করে, যা সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় এনে দেয়। ২০১২ সালের উপনির্বাচনে সু চি সংসদের নিম্নকক্ষের এমপি হন এবং তার দল ৪৫টি ফাঁকা আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়লাভ করে।
২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার দল ল্যান্ড স্লাইড বিজয় অর্জন করে। সু চি-র প্রয়াত স্বামী ও সন্তানেরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় সংবিধান অনুসারে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না; তাই তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা পদটি গ্রহণ করেন যা কিনা মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের সমান।
গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষে সংগ্রামের জন্য তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার (১৯৯১) সহ রাফটো পুরস্কার, শাখারভ পুরস্কার, জওহরলাল নেহরু পুরস্কার, আন্তর্জাতিক সাইমন বলিভার পুরস্কার, ওলফ পালমে পুরস্কার,
ভগবান মহাবীর বিশ্বশান্তি পুরস্কার, ইউ এস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল এগুলো পান। এতগুলো পুরষ্কার পাবার পর ২০১২ সাল থেকে তিনি এমপি হবার পর থেকেই রোহিঙ্গা সংকট প্রকট হতে শুরু করে এবং প্রথম রোহিঙ্গা ফ্লাক্স বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার দল ল্যান্ডস্লাইড বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় এলে ২০১৭ তে রোহিঙ্গা গণহত্যা ঘটে এবং ঐ সময় বিপুল পরিমান রোহিঙ্গা শরনার্থী হিসাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
মানিবাধীকার কর্মী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রসঙ্গে অং সান সু চির নীরবতার সমালোচনা করেন।
২০১৫ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের ক্ষেত্রেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে, এবং মায়ানমারের নিপীড়িত সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পলায়নও সু চি ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করেন।
২০১২ সালে তিনি রিপোর্টারদের বলেন যে রোহিঙ্গাদেরকে বার্মার নাগরিক বলে ভাবা যাবে কি না তা তিনি জানেন না।
২০১৩ সালে বিবিসির মিশাল হুসাইনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে সু চি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা করেননি এবং মায়ানমারে মুসলিমদের জাতিগত নির্মূল হতে থাকার কথা অস্বীকার করেন, বরং জোর দিয়ে বলেন যে “বৈশ্বিক মুসলিম শক্তি অনেক গ্রেট – এই বিশ্বব্যাপী কল্পিত ধারণা”র কারণে সৃষ্ট “আতঙ্কের আবহে”ই সেখানে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
পিটার পপহ্যামের মতে, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী মুসলমান ছিলেন বলে সাক্ষাৎকারের পরে সু চি রাগ প্রকাশ করেন। সু চি দাবি করেছিলেন যে দুপক্ষেই সহিংসতা হচ্ছে, তখন হুসাইন তাকে চ্যালেঞ্জ করেন যে সহিংসতার প্রায় সব প্রভাব কেন শুধু রোহিঙ্গাদের ওপরই পড়ছে। পিটার পপহ্যাম সু চির এরূপ অবস্থানকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দ্ব্যর্থবোধক অবস্থান বলে মন্তব্য করেন।
২০১৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সাথে আলাপকালে তিনি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি হিসেবে অভিহিত করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে যা ২০১৯ সালে ডেভিড ক্যামেরনের ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতি নিয়ে ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন।
যাইহোক, সু চি বলেন যে তিনি সমঝোতার জন্য কাজ করতে ইচ্ছুক এবং তিনি কোনো পক্ষে যাবেন না, কারণ দুপক্ষই সহিংসতায় জড়িত।
দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকার মতানুসারে, তার “রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের পক্ষে তিনি স্পষ্ট অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার জ্যোতির্ময় মহিমা বিদেশি মানবাধিকার লবিস্টদের সামনে পদস্খলিত হয়েছে।”
সু চির এই অবস্থানকে নিছক মুসলিম বিদ্বেষ মনে করে ভুল করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ তাদের কাছে মার্কিন ভূরাজনীতির বিষয়টা ট্যাবু বা আলোচনায় আনা নিষিদ্ধ।
আসলে চীনের জ্বালানী নিরাপত্তা বিঘ্ন করতে এবং ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোকে নিরাপত্তাহীন করে এই অঞ্চলকে ঝুকিপূর্ণ করার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরকল্পনাতেই বিখ্যাত করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে অং সান সু চিকে।
কিন্তু সীমানার একদিকে নোবেল শান্তি পুরষ্কার ও মার্কিন কংগ্রেশনাল মেডেল প্রাপ্তদের দিয়ে গণহত্যা ঘটানো যায় কিন্তু বাফার স্টেট তৈরি কার যায় না। এখন সীমান্তের অপর পারেও মার্কিন কংগ্রেশনাল মেডেল ও নোবেল শান্তি পুরষ্কারপ্রাপ্ত এসে গেছে।
এর মধ্যেই পুলিশ বাহিনীকে ডিমোরালাইজড করা হয়েছে আর সামরিক বাহিনীকে করা হয়েছে “ভদ্র ছেলে”, আইএসআই, সিআইএ, আরসা এই সুযোগটাই কি খুঁজছে না? কি মনে হয়? বাংলাদেশেও খুব শীঘ্রই মিয়ানমারের মত নোবেল শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না?
১৯৪৭ এ স্বাধীন হয়ে মিয়ানমার প্রথমে কিছুটা মিশ্র গণতান্ত্রিক থাকলেও ১৯৬২ এর পর থেকেই সামরিক শাসনে নিষ্পেষিত। কিন্তু গণহত্যা, গৃহযুদ্ধ বা ব্যপক জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেনি। নোবেল শান্তি অং সান সু চির ক্ষমতায় আসার পর এখন দেশটা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। আমাদের ভবিষ্যত কি?