আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সুযোগ নিয়ে যুদ্ধাপরাধী ছেলে সংবাদ সম্মেলনে এসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শেখাচ্ছেন, দাবি করেছেন জাতীয় সংগীত পাল্টাতে হবে।
এনওয়াইবিডি রিপোর্ট
আওয়ামী লীগ সরকার পতনে আকাশে উড়ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামী।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে বিচারে ফাঁসিতে ঝোলানো মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী আর রাজাকার বাহিনীর সদস্য আবদুল কাদের মোল্লাকে শহীদ আখ্যা দিয়ে তারা গান গাইছে, সেই গান বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে এখন সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে।
এবার ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘শায়েস্তা করতে’ স্বাধীনতাবিরোধীদের গুরু যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লহিল আমান আযমী সংবাদ সম্মেলনে এসে জাতীয় সংগীত পাল্টানো, নতুন করে সংবিধান লেখার দাবি করেছেন। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে মীর জাফর বলে গালিও দিয়েছেন।
আযমীর দাবি, ২০১৬ সালে তার বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আটক তাকে অজ্ঞাত স্থানে বন্দি রাখা হয়।
সেসব কথা জানাতে তিনি সংবাদ সম্মেলনে আসেন। এসে মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সংগীত, বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানকে আক্রমণ করেন। দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়নি।
আরও দাবি করেন, ১৯৭১ সালের অক্টোবরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে একটি মৈত্রী চুক্তি করেছিল। তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন না, দেশবাসীর জানা উচিত, মৈত্রী চুক্তি নামে অস্থায়ী সরকার একটা চুক্তি করেছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই চুক্তিতে সাক্ষর করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।’
যুদ্ধ চলাকালে ৯ মাস গোলাম আযম মুক্তিযোদ্ধাদের শায়েস্তা করার নানা চেষ্টা করে গেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতায় ছক করেছেন, রাজাকার, আল বদর, আল শামস ইত্যাদি নানা বাহিনীর পাশাপাশি শান্তি কমিটি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বিজয়ের আগের মাসে নভেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তান উড়ে যান গোলাম আযম, যাওয়ার আগে রাজাকার বাহিনীর হাতে উন্নত অস্ত্র দেওয়ার দাবি জানিয়ে যান।
সেই স্বাধীনতাবিরোধী নেতার ছেলে এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাঠ দিয়ে বলেছেন, সেই চুক্তির প্রথমে ছিল এ দেশে কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না, ভারতীয় সেনাবাহিনী থাকবে, দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধে প্রশাসনের যারা যোগদান করেছিল, তাদেরকে রেখে বাকিদেরকে অপসারণ করতে হবে এবং ভারতীয়রা এ দেশের প্রশাসন চালাবে।
দেশের প্রশাসনের এক শতাংশও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়নি দাবি করেন গোলাম আযম পুত্র বলেন, ‘তার মানে এ দেশের প্রশাসনও তাদের (ভারত) হাতে তুলে দেবে।
তৃতীয়ত, এই দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
এসব কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দেশবাসীর কাছে জানতে চাই, এটা স্বাধীনতার চুক্তি, মৈত্রী চুক্তি না গোলামির চুক্তি?’
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের নেতাদেরকে গালি দিয়ে গোলাম আযমের ছেলে বলেন, ‘এই চুক্তি যারা করেছে, তারা মীরজাফরের বংশধর। তারা এই দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছিল, আল্লাহ রক্ষা করেছেন।’
৩০ লাখ নয়
মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা কমিয়ে দেখাতে চান গোলাম আযমের ছেলে। তিনি বলেন, “শেখ মুজিব সাহেব ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছেন এবং এটাই ৩০ লাখ হয়ে গেছে।”
কোনো জরিপ ছাড়া ৩০ লাখ শহীদ বলে বঙ্গবন্ধু মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, এমন দাবিও করেন যুদ্ধাপরাধীর ছেলে।
তিনি বলেন, “আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আপনারা জরিপ করে বের করেন, একচুয়ালি ৩০ লাখ হোক আর ৩ কোটি হোক। আমার জানামতে, এটা ২ লাখ ৮৬ হাজার। তারা ৩ লাখকে ৩০ লাখ বানিয়ে ফেলেছে। এখনো সময় আছে, জাতিকে সত্য ইতিহাস জানতে দিন। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মিথ্যার উপরে আপনারা গড়ে তুলতে দেবেন না। সত্যিকার একটা জরিপ করে আপনারা ব্যবস্থা করেন।”
‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধাদের অবদান বেশি’
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে দেখছেন গোলাম আযম পুত্র। তার দৃষ্টিতে এই আন্দোলনে যারা ছিল, তাদের অবদান ১৯৭১ সালের যোদ্ধাদের চেয়ে বেশি।
সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনী মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল, এমন দাবিও করেন, যদিও প্রকৃতপক্ষে নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গঠন করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও গঠন হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আদেশে।
তবে গোলাম আযমের পুত্রের দাবি, সশস্ত্র সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী প্রথম শুরু করেছে, তারপর আপামর জনগণ প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, “তাদের অবদান (মুক্তিযোদ্ধা) যেমন অস্বীকার করা যাবে না, তেমনি আজকের তরুণ যুবক ছাত্র জনতা যেভাবে কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়া, কোনো রকম অস্ত্র ছাড়া নিজের বুক পেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘যুদ্ধ’ করেছে, তাদের অবদান আরও বেশি বলে আমি মনে করি।”
আযমী বলেন, “যে জন্য আমি জোর দাবি জানাই, ‘প্রথম মুক্তিযুদ্ধে’ যেমন শহীদ এবং সাহসীদের বিভিন্ন বীরত্বপূর্ণ খেতাব… বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরপ্রতীক দেওয়া হয়েছে, তেমনি ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে’ আবু সাঈদসহ শহীদ এবং অন্যান্য যারা আহত হয়েছে এবং যারা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তাদেরকেও যথাযথভাবে সাহসিকতাপূর্ণ বীর শ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হোক।”
এ জন্য একটা কমিটি করার দাবিও জানান স্বাধীনতাবিরোধী নেতার ছেলে।
জাতীয় সংগীত পাল্টানোর দাবি
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে, সেটি ষাটের দশকেই ঠিক করে রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেটি পাল্টানোর দাবি করেন গোলাম আযম পুত্র।
তিনি বলেন, “১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই?
“আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশ থাকতে চাই। এই জাতীয় সংগীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা হোক।”
প্রথম সংবিধান ‘অবৈধ’, নতুন সংবিধান দাবি
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দেন যুদ্ধাপরাধীর ছেলে। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, “১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেড নিয়েছিল পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য, স্বাধীন সংবিধান রচনা করে নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি- আলহামদুলিল্লাহ।
“কিন্তু তারা জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়ণের কোনো ম্যান্ডেড নেয়নি। সুতরাং এই সংবিধান আমার দৃষ্টিতে বৈধ নয়। নতুন করে একটা কমিটি করে নতুন সংবিধান তৈরি করা হোক, এটা বাতিল করা হোক।”
গোলাম আযমের পুত্রের দাবি অনুযায়ী, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ীদের নেতৃত্বে লেখা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান অবৈধ। তবে এখন অনির্বাচিত সরকারের কাছেই তিনি নতুন সংবিধান চাইলেও সেটি কীভাবে বৈধ হয়, তার ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি দেননি।
প্রসহনের বিচার
২০১৩ সালের ১৫ জুলাই গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে রায় দেয়, তাতে তাকে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার কারণ হিসেবে তার বয়সকে সামনে আনা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে গোলাম আযমের ভূমিকা কারও অজানা নয়। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর পর দিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্য নেতাদেরকে নিয়ে সাক্ষাৎ করেন, রেডিওতে ভাষণ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ভারতীয় চর’ আখ্যা দিয়ে তাদের হত্যার আহ্বান জানান।
বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মারা যান গোলাম আযম।
তবে যুদ্ধাপরাধীদের গুরুর ছেলের দাবি, “২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি এক প্রহসনের ট্রাইব্যুনাল তাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেয়। উনি প্রায় পৌনে তিন বছর চিকিৎসাধীন অবস্থায় থেকে জালেমের কারাগারে থাকতে থাকতে সুচিকিৎসার অভাবে ২০১৩ সালের ২৩ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন।”