উপদেষ্টা মণ্ডলীর বৈঠকে ১৫ আগস্টের ছুটি বাতিল সংবিধান ও হাইকোর্টের আদেশের বিরোধী। সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে সেটি লঙ্ঘন হয়েছে।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভারতে যাওয়ার খবর ছড়াতেই ৫ অগাস্ট গণভবনের সামনে জড়ো হয় হাজারো মানুষ। তাদের কি ভেতরে ঢোকার ইচ্ছা ছিল? নাকি সেনাবাহিনীর সদস্যরাই ইঙ্গিত দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়?
গণভবনে লুটপাট চলার সময় আরেক দল ছুটে যায় বিজয় সরণিতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে দিতে। নান্দনিক এই ভাস্কর্যটি বাংলাদেশের জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তৈরি করেছিল সেনাবাহিনীই। গণভবনের মত মত এই ভাস্কর্যকে রক্ষার জন্যও সেই সেনাবাহিনীর ন্যূনতম কোনো উদ্যোগই ছিল না।
প্রায় একই সময়ে দেশের প্রায় সব জায়গায় আক্রান্ত হয় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সব স্থাপনা। এমনকি আনসার অ্যাকাডেমিতেও ব্যাপকে উৎসাহে ভেঙে দেওয়া হয় বিশাল ভাস্কর্যটি। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজরিত ঐতিহাসিক বাড়িটিও।
বোঝাই গিয়েছিল সরকার পতনের সুযোগে বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা মুছে ফেলতে চায় তথাকথিত অভ্যুত্থানকারীরা।
এবারই প্রথম না, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ক্ষমতায় এসে একই কাজ করেছে। তাদের সব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা মুছে দেওয়া।
এবারও তার অন্যথা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়ে তার শাহাদাৎ বার্ষিকী ১৫ আগস্টে হাত দিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার, যিনি কিনা সব ভেদাভেদ দূর করে বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেন সব সময়; বলেন প্রতিহিংসা থেকে দেশকে বের করে আনবেন।
কিন্তু উপদেষ্টাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আদেশটিই হলো প্রতিহিংসার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ বার্ষিকীতে জাতীয় শোক দিবসে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা ও সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
অথচ এই সিদ্ধান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কি নিতে পারে? প্রথমত তারা স্থায়ী সরকার না, তাদের পক্ষে নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। সংবিধান অনুযায়ী তারা নির্বাচনের আয়োজন করে সরে যাবে ৯০ দিনের মধ্যে, সর্বোচ্চ সময় নিতে পারবে ১৮০ দিন।
সংবিধানের কথা বলা হচ্ছে এ কারণে যে, সংবিধান স্থগিত বা রদ হয়নি। আর গত ৮ আগস্ট বঙ্গভবনে ইউনূস শপথ নিয়েছেন সংবিধান রক্ষার, কোনো অনুরাগ, বিরাগের বশবর্তী না হয়ে কাজ করার।
সংবিধানে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার আসন দেওয়া আছে। তার জন্ম ও মৃত্যু দিবসে সরকারি ছুটি বাতিল তাই সংবিধানের চেতনার সঙ্গে যায় কিনা, সেটি আইনি বিষয়। কিন্তু এর পেছনে যে রাজনীতি আর জিঘাংসাটা ইউনূস ও তার অন্তর্বর্তী সরকার গোপনও করতে চায়নি।
এই সিদ্ধান্ত কিন্তু উচ্চ আদালতের রায়েরও বিরোধী। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে হাই কোর্ট এক রায়ে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারও কিন্তু দিবসটি পালন করেছিল।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগের দিন একটি দারুণ নাটক মঞ্চস্থ হয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনের পরামর্শ দেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরার পরামর্শ দেন। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশ করে উপদেষ্টাদেরকে টেনে নামানের হুঁশিয়ারি দেয়।
একই দিন বিএনপি, স্বাধীনতাবিরোধী ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ দল জামায়াতে ইসলামী, এই দলটি ভেঙে জন্ম নেওয়া এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ ইত্যাদি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন ইউনূস।
মঙ্গলবার উপদেষ্টাদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এতে লেখা হয়, “উপদেষ্টা পরিষদের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে ব্যাপক ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে ঘোষিত ১৫ অগাস্টের সাধারণ ছুটি বাতিলের বিষয়টি অদ্যকার উপদেষ্টা মণ্ডলীর বৈঠকে অনুমোদিত হয়েছে।”
বাহ, এই দলগুলো কখনো বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করেছে? দলগুলো কখনো ১৫ আগস্ট পালন করেছে? এরা কি কখনো মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে? তারাই দেশের রাজনৈতিক দল?
১৯৭৫ পরবর্তী দলগুলোর ধারাবাহিকতাই রক্ষা করছে ইউনূস সরকার। এভাবে তারা দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও সবচেয়ে বড় দুই দলের একটি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে দেশে ‘ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়! তাহলে এতদিন যে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অনুসারীরা বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি ও নির্বাচনের কথা বলত, সেগুলো কি ফাঁপা বুলি?
আসলে জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিবকে তার শত্রুরা কখনো কম ভয় পায়নি। এজন্য ২১টি বছর তার হত্যার বিচার পর্যন্ত আটকে রাখা হয় সংবিধান সংশোধন করে খুনিদের দায়মুক্তি দিয়ে।
এই সেদিন ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির শীর্ষ নেতারা কেউ প্রকাশ্যেও নেই। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে পুড়িয়ে দেওয়া বাসভবন ও স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।
কিন্তু এতে ভয়ে প্রমাদ গুনছে সরকার। তাদের সঙ্গে আছে বিএনপি-জামায়াত ইত্যাদি ইত্যাদি আর ড. ইউনূসের বিকশিত না হওয়া দল নাগরিক শক্তির সঙ্গে মিল রেখে ছাত্র শক্তি নামে সংগঠন।
ছাত্র শক্তি অবশ্য এখন আর নিজ নামে কিছু করছে না। তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামেই এখনও চালিয়ে যাচ্ছে, তারা ১৫ আগস্টকে ঘিরে সাত দিন মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এই সপ্তাহের নাম তারা দিয়েছে ‘রেজিস্ট্যান্স উইক’। মাঠে থাকবে বিএনপি-নিষিদ্ধ জামায়াত ও তাদের সঙ্গে থাকা দলগুলোও।
এই দল ও তার অনুসারীরা ফেসবুকে লেখালেখি করছে, তারা ‘প্রতি বিপ্লবের’ ভয় পাচ্ছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনকে তারা বিপ্লব হিসেবে দেখাতে চাইছে। কিন্তু ১০ দিন যেতে না যেতেই পাশার দান উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা করছে? এর কারণটা কিন্তু বঙ্গবন্ধু।
সরকার পতনের পর পর দেশের নানা প্রান্তে বিশাল বিশাল মিছিল বের হচ্ছে আওয়ামী লীগের নামেই। সেটি দেখেই চোখ কপালে উঠার দশা। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ঘিরে যদি সত্যিই মিছিলের স্রোত বয়ে যায়, তখন কোথাকার জল কোথায় গড়ায় এই ভয়ে ভীত তারা।
আওয়ামী লীগের নেতারা প্রকাশ্যে নেই, কেবল অনুসারীরা ফেইসবুকে আহ্বান জানিয়ে শোক দিবস পালন করতে বলেছে, এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ভেঙে দেওয়া ম্যুরালে জনতা গিয়েই ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছে। একজন প্রবীণ মানুষের বঙ্গবন্ধুর ছিড়ে ফেলা একটি ছবি সুঁই সুতা দিয়ে সেলাই করার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি দেশের মানুষের ভালোবাসা আর মমত্ববোধের ঘাটতি কখনো কম ছিল না, কখনো কমতিও হবে কি?
গত বছর থেকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচির দিন ‘শান্তি মিছিল’ বা ‘শান্তি শোভাযাত্রা’ ইত্যাদি কর্মসূচির ঘোষণার পর নিন্দামন্দের অভাব ছিল না। আজ সেই তারাই একই পথের পথিক হয়েছে। আর এর সমালোচনাও কিন্তু কেউ করছে না।
কথা হলো ২১ বছর বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করে রেখে, বঙ্গবন্ধুকে প্রায় নিষিদ্ধি করে রেখে লাভ কী হয়েছে? সে সময় সরকারি প্রচার যন্ত্র আর সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ছাড়া তো মিডিয়া বলতে কিছুই ছিল না। সামাজিক মাধ্যমের এই যুগে বঙ্গবন্ধুকে কি মুখে ফেলা যাবে?
তার ভাস্কর্য ভেঙে, তার ম্যুরাল গুঁড়িয়ে দিয়ে, তার ছবি পুড়িয়ে দিয়ে, সংবিধান থেকে তার নাম মুছে ফেলে লাভ কি আসলে কিছু হবে?
ইউনূস সরকারের নাটাইটা যে যুক্তরাষ্ট্রে সে কথা দেশে অজানা নয় কারও কাছে। বঙ্গবন্ধু হত্যায় দেশটির সম্পৃক্ততার তথ্য ২৫ বছর পর প্রকাশিত নথিপত্রে ঠিকই উঠে এসেছে। তবে এর আগে তারা কখনো তা স্বীকার করেনি। এবারও হয়ত দেশটি খুশিই হবে এসব পদক্ষেপে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে নাক গলিয়ে আইনের শাসন, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি ইত্যাদি ইত্যাদি বুলি আওড়েছে গত কয়েক বছর। কিন্তু এখন চর দখলের মত উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সংস্থা এমনকি স্কুল কলেজের অধ্যক্ষের পদ দখল হচ্ছে; কেবল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত, এ কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট হচ্ছে, বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, কিন্তু এখন সব চোখ বন্ধ।
কোটা আন্দোলনের নামে মাঠে নেমে সরকার পতনের চেষ্টার খবর সরকারের কাছে আগেই ছিল। সেই প্লটটা এত নিখুঁতভাবে সাজানো হয়েছে, যে সাধারণ মানুষ খুব একটা টের পেয়েছে বলা যাবে না।
তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন একটি কথা। সেটি হল টার্গেট কিলিং হয়েছে এবং তার কাছে খুবই আশ্চর্য লাগছে যে পুলিশের গুলিতে কম মানুষ মারা গেছে। ৭.৬২ রাইফেলের গুলিতেই নিহত হয়েছে বেশিরভাগ মানুষ। এই অস্ত্র বেসরকারি খাতে নিষিদ্ধ। সেই অস্ত্রে এত মানুষের মৃত্যু কীভাবে হল, সেটি নিয়ে তদন্ত হবে।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বানানোর মিশন শুরু হয়েছে। নুরের মুখ দিয়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হয়েছে। পরে হয়ত অন্যরা বলবে।
পুলিশ গুলি করেছে, এটা সত্য। তবে কোন পরিপ্রেক্ষিতে গুলি হয়েছে, সেই আলোচনা তোলার মত সুযোগও নেই। পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণের ভিডিও তার স্টিল ছবিও কিন্তু ইনবক্সে আর হোয়াটস অ্যাপে শেয়ার হচ্ছে। সেগুলো এতটাই বীভৎস যে, তা দেখা যায় না, গা গুলিয়ে উঠে।
শক্তি যে দুই পক্ষই প্রয়োগ করেছে, তাও কিন্তু স্পষ্ট। কিন্তু সে কথা বলা যাবে না। কথা বলতে হবে তথাকথিত বিপ্লবের পক্ষে, যারা বলবে না, তাদেরকে তালিকা করে মিডিয়া থেকে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটাকে অবশ্য ফ্যাসিজম বলা যাবে না, এর বিরুদ্ধে কথাও বলা যাবে না।
কিন্তু এখন যারা ক্ষমতায় বা যারা তাদের সাথে, তাদের মতের বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলা যাচ্ছে না, দল বেঁধে তেড়ে আসছে সবাই, একদিন বিটিভিকে ‘বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন’ বলে কটাক্ষ করা হতো, এখন সব টিভিই বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন হয়ে গেছে।
পত্রিকায় বাজারদরের প্রতিবেদন পড়ে বাজারে গিয়ে ধোঁকা খেয়ে ফিরছে মানুষ। পত্রিকায় লেখা হচ্ছে জিনিসপত্রের দাম কমে গেছে, আসলে কিন্তু তা নয়।
বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন এখন পত্রিকাতেও!