বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রশাসনে নিয়োগে জামায়াতের ইচ্ছাই প্রাধান্য পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবীকে। তিনি আওয়ামী লীগ ও দলের শীর্ষ নেতাদের বিচারের উদ্যোগ নেবেন।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে কথিত অন্তর্বর্তী সরকার এখন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যত নিয়োগ দিচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আক্ষেপ তত বাড়ছে। নিয়োগগুলোতে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর পছন্দই যে গুরুত্ব পাচ্ছে, তা এখন দেশের জানাবোঝার লোকেরা ঠিকই টের পাচ্ছে। তথ্য মিলছে, বিএনপিও এখন বুঝতে পারছে কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে এসে বেশ হাসিমুখে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। তার এই আশার বেলুনে প্রথম ধাক্কা দেয় জামায়াত। দলটির আমির শফিকুর রহমান সাফ জানিয়ে দেন, এই সময়ে নির্বাচন নির্বাচন জপ তুললে জনগণ তা মেনে নেবে না।
এরপরও মির্জা ফখরুল গত ২৪ আগস্ট থেকে টানা কয়েকদিন নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার দাবি করেছেন। কিন্তু ২৯ আগস্ট ড. ইউনূসের সঙ্গে তার ভাষায় সফল বৈঠক করার পর তার মুখ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। নির্বাচন নিয়ে আর একটি কথাও বলেননি তিনি।
ইউনূস সেদিন বিএনপির সাবেক জোট সদস্য বা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে যে আলোচনা করেছেন, তাদের সবাই বলেছেন, আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন। এরপর থেকে বিএনপিরও বুঝে গেছে এই সরকারের ভাবনায় আর নির্বাচন নেই।
এর মধ্যে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম একটি অনলাইন দৈনিককে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, তারা ‘বিপ্লবি’ সরকার। এই সরকারের কাজ নির্বাচন দেওয়া না।
অর্থাৎ জাাময়াতের চাওয়া আর ইউনূস সরকারের কর্মকাণ্ড একই বৃত্তে মিশে গেছে।
শুরুর দিকে ইউনূস সরকার প্রশাসন ও বিচার বিভাগ পুনর্গঠনে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে, তাতে বিএনপি নাশোখ ছিল না। দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানকে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়; সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক বা দুটি বা তিনটি পদোন্নতি দিয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে যুগ্ম বা অতিরিক্ত সচিব করে দেওয়ার সিদ্ধান্তগুলো বিএনপির জন্য সন্তোষজনকই ছিল।
তবে ইদানীং যা হচ্ছে, তাতে বিএনপির চেহারায় খুশির ভাবটা অনেকটাই উধাও। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা প্রশাসনিক বড় পদে নিয়োগে জামায়াতের ইচ্ছাই প্রাধান্য পাচ্ছে, বিএনপি পাত্তাই পাচ্ছে না না।
এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে, সেখানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার সদস্য, দল, সহযোগী সংগঠন ছাড়াও আওয়ামী লীগ সমর্থক সাংবাদিকদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এই কাজের অংশ হিসেবে চিফ প্রসিকিউটর, অর্থাৎ রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে এমন একজনকে, যাকে দেখে মানুষের চোখ কপালে উঠেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় খুনে বাহিনী আলবদরের নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, এটিএম আজহারুল ইসলাম, রাজাকার বাহিনীর সদস্য আবদুল কাদের মোল্লা, যুদ্ধাপরাধীদের গুরু গোলাম আযমের আইনজীবী তাজুল ইসলামকেই বেছে নিয়েছে ইউনূস সরকার।
সংঘাতে পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করতে হলে আন্তর্জাতিক আইনেই পরিবর্তন আনতে হবে। তবে ইউনূস সরকার কথিত ইনক্লুসিভ দেশ গড়ার কথা বলে আসলে জামায়াতকেই যে পুনর্বাসন করতে চাইছে, তার একটি প্রমাণ হিসেবে এই বিষয়টিকেই দেখা যায়।
মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যায় সহায়তাকারীদের আইনজীবী এবার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের বিচারের জন্য লড়বেন। যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবী লড়বেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসাতে।
জাতীয়-আন্তর্জাতিক অনেক শক্তির বহু বছরের চেষ্টার পর অনেক মানুষের অংশগ্রহণে একটি আন্দোলন হয়েছে, এটি মিথ্যা না, সেই আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শক্তিশালী একটি সরকারের পতন হয়েছে, সেই আন্দোলনে পুলিশের বেপরোয়া গুলির ঘটনা যেমন ছিল, তেমনি অন্তত ৫৬ জন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
৪ আগস্ট থেকে আবার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা দলীয় কার্যালয় বা বাইরে কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। সব হিসাব অবশ্য এখন এককভাবে আটশ বা ৯০০ জনের মৃত্যু বলা হচ্ছে।
৪ আগস্ট কিশোরগঞ্জে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের চাচাত ভাই সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটোর বাড়িতে আগুন দিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় তিন জনকে। এই ঘটনাতেও শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় অনেক নেতাকে আসামি দারুণ হবে।
যখন মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার মত প্রমাণিত একটি বিষয়ের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল, তখন কথিত আন্তর্জাতিক মানের বিচারের দাবিতে দেশে বিএনপি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু মানবাধিকার সংগঠনের শোরগোল শোনা যাচ্ছিল।
এবার যুদ্ধাপরাধীর আইনজীবীর নেতৃত্বে সেই সরকারের কর্তাব্যক্তি আর সে সময়ের ক্ষমতাসীনদের বিচারের ব্যবস্থা করেছে ইউনূস সরকার। এখন আর দেশ বা বিদেশে কেউ কোনো আলোচনা তুলছে না।
এর মধ্যে রাজশাহীতে এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার নাম আবদুল্লাহ আল মাসুদ। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় শিবির কর্মীরা তার এক পা কেটে নিয়েছিল।
গত সপ্তাহে তার একটি কন্যা সন্তান হয়েছে। সেই সন্তানের জন্য ওষুধ কিনতে যাওয়ার পর শিবিরের কর্মীরা আবার তার ওপর হামলা করে। কিন্তু দেশের পত্রিকাগুলোতে সেই শিবির কর্মীদের নামধাম কিছুই আসেনি। শিবিরের নামটিও আসেনি। লেখা হয়েছে ‘একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের হামলায়।’
একটি মূলধারার গণমাধ্যমের শীর্ষ পদে থাকা একজন বলেছেন, ‘এখন অনেক চাপ। জামায়াতকে আগের মত স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী দল’ লেখার দরকার নেই। সুস্পষ্ট হুমকি আছে।’
এর মধ্যে আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি রাজনৈতিক দল চালুর প্রাথমিক কাজ শুরু করে দিয়েছে। আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে একটি সংগঠনের। এর আহ্বায়ক করা হয়েছে মুহাম্মাদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সদস্য সচিব হয়েছেন আখতার হোসেন।
নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারি জামায়াতের ‘বি টিম’ নামে পরিচিত এবি পার্টিতে যোগ দেন তিনি ২০২২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। এর আগে ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা ছিলেন। এবারের ছাত্র আন্দোলনেও তার ভূমিকা ছিল। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য।
মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর যখন বিচার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন জামায়াতের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক এবং আরও কয়েকজনের বুদ্ধি পরামর্শে গঠন করা হয় এবি পার্টি।
জামায়াত যদি রাজনীতিতে ফিরতে না পারে, তখন এই দলটিকে নিয়ে আগানোর পরিকল্পনা ছিল। তবে হঠাৎ করেই জামায়াতের সামনে দুয়ার খুলে গেছে, এখন এবি পার্টি অন্য ভূমিকায়।
ইউনূস সরকার ও তার সঙ্গে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কথিত যে ইনক্লুসিভ রাজনীতির কথা বলছে, সেখানে ইসলামী জাতীয়তাবাদীদেরকে মূলধারার রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করছেন।
এই কথিত ইনক্লুসিভের আলোচনায় কিন্তু বামপন্থি রাজনৈতিক দল বা আওয়ামী লীগ নেই। এমনকি বিএনপিও নেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তির এই চেষ্টা চলছে, সেখানে জামায়াতের ‘বি টিমকে’ যুক্ত করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখানে জামায়াতও আছে।
জামায়াত কিন্তু জেলায় জেলায় উপজেলা উপজেলায় সমাবেশ, সভা, আলোচনা সভা করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। সেখান থেকে বিএনপিকে ‘দখলদার’, ‘চাঁদাবাজ’ ইত্যাদি বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে ভবিষ্যত জামায়াতকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানোর উপায় খুঁজতেই মরিয়া ইউনূস সরকার। সংস্কারের আলোচনা ভেক মাত্র।