উজানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢল ও গত কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণে দেশের ১০ জেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন ও ক্ষতির মুখে পড়েছেন ৩৬ লাখ মানুষ। পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে গত দুই দিনে চার জেলায় আটজনের মৃত্যু হয়েছে।
গত বুধবার থেকে আট জেলায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়। বৃহস্পতিবার আরও চার জেলাসহ মোট ১২ জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। জেলাগুলো হলো ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। বন্যার্তদের সহায়তায় পাঁচ জেলায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ ও খাদ্য বিতরণ করছেন সেনাসদস্যরা।
বন্যার পানিতে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের অনেক স্থানে পানি। ওই সড়কে যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক মোবাইল টাওয়ার অচল হয়ে পড়েছে। এতে কার্যত ওই সব এলাকার মানুষ যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
আকস্মিক বন্যায় বড় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে ফেনীতে। ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার পর ফেনী পৌর শহরও গতকাল পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর, কোথাও বুকসমান পানি। ফেনী সদরের বিভিন্ন এলাকা কার্যত পানির নিচে। কোথাও বুকপানি, কোথাও গলাপানি। দক্ষিণ মাইজবাড়িয়া, হাফেজিয়া মাদ্রাসা, ভাঙ্গা তাকিয়াসহ একাধিক গ্রামে এ দৃশ্য দেখা যায়।
গ্রামের পর গ্রামের বেশির ভাগ একতলা ঘর তলিয়ে গেছে। ফসলি জমি, পুকুর, রাস্তাঘাট ডুবে আছে। কেউ কেউ কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ বুকপানিতে সাঁতরে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
টানা বর্ষণের ফলে নোয়াখালীর আটটি উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ডুবে গেছে ফেনী-নোয়াখালী সড়কের চৌমুহনী–মাইজদী অংশের একাধিক এলাকা। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুটে চলছে অনেকে।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জে ১০ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। তলিয়ে গেছে কয়েক শ মাছের ঘের, আউশ ধান ও আমনের বীজতলা। ঢলের সঙ্গে কুমিল্লায় এক দিনেই ২২০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। আখাউড়ায় বাঁধ ভেঙে ৩৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গত বুধবার সকাল থেকে আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ও স্থলবন্দরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল দিয়ে সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড়ি ঢল আসতে শুরু করে। বুধবার সকাল থেকে ইমিগ্রেশনের সব কার্যক্রম বন্ধ আছে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, রাউজান ও হাটহাজারীর বেশির ভাগ গ্রামীণ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যায় পানিবন্দী হয়ে আছেন এই তিন উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ। বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, নাজিরহাট, খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়ক।
ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের রামুতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন অন্তত ২৩ হাজার মানুষ। জেলার পেকুয়া উপজেলার শিলখালী ও টৈটং ইউনিয়নের অন্তত ১১টি গ্রামীণ সড়ক ভেঙে গেছে।
প্রবল বর্ষণ ও ঢলে ভেসে গেছে পাহাড়ি শহর খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির সমতল ও নিচু এলাকা, খেতখামার ও পুকুর। ডুবে আছে বিস্তীর্ণ এলাকার বসতবাড়ি। খাগড়াছড়ি শহরের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বন্যার পানিতে ডুবে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আটজন মারা গেছেন। এর মধ্যে কুমিল্লায় চারজন, কক্সবাজারে দুজন, ফেনীতে একজন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন মারা গেছেন। পানির তোড়ে ভেসে যাওয়া কক্সবাজারের দুজন নিখোঁজ আছেন।
কুমিল্লায় দুজন বন্যার পানিতে তলিয়ে, একজন বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং একজন মাথায় গাছ পড়ে মারা গেছেন। গত বুধবার কুমিল্লা নগর, লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম ও নাঙ্গলকোট উপজেলায় এ ঘটনা ঘটে পানিতে তলিয়ে মারা যাওয়া শিশুর নাম-পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
কক্সবাজারের রামুতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন অন্তত ২৩ হাজার মানুষ। বাঁকখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। স্রোতে ভেসে গেছেন চারজন। বিকেল পাঁচটার দিকে এক শিশুসহ দুজনের মরদেহ ভেসে উঠলেও অপর দুজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে একজন মারা গেছেন। তাঁর পরিচয় জানা যায়নি। আর গত বুধবার দুপুরে বন্যার পানিতে ডুবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার বীরচন্দ্রপুর গ্রামে সুবর্ণা আক্তার (১৯) নামের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী মারা যান।