লেখক : অমি রহমান পিয়াল
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুখী এবং সফল মানুষ কে?
এ প্রশ্নে আপনার উত্তর যদি ড. মুহাম্মদ ইউনূস হয়, তাহলে আপনি ১০০ তে শুন্য পাবেন। ধরুন ড. ইউনূস দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখেছেন বাংলাদেশকে নিজের ইচ্ছেমতো গড়বেন, একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করবেন, দেশ থেকে সব অন্যায় অবিচার দূর করবেন, সব দুর্নীতিকে এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিবেন এবং এখন তিনি সে সুযোগ পেয়েছেন। সুতরাং তার চেয়ে সুখী এবং সফল মানুষ সারা বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই।
এরকম মনে হওয়া ভুল। ড. ইউনূস খুবই জ্ঞানী মানুষ। তিনি নিজেও জানেন তিনি রাজনীতিবিদ নন। দেশ শাসন তার জন্য নয়। এজন্যই ওয়ান ইলেভেনের কালে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি রণে ভঙ্গ দেন। এবার শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পরও পরিস্থিতি বুঝতে তিনি ৩ দিন সময় নিয়েছেন। তিনি আন্দোলনের অংশ ছিলেন না, নেতৃত্বে তো নয়ই। সরকারের সঙ্গে তার বিরোধের কারন ছিলো আর্থিক। বিভিন্ন সময়ে তিনি যে কর ফাঁকি দিয়েছেন, সরকার অবশেষে সেসব ফাইলে টান দেয়াতেই তিনি অসুবিধার মধ্যে ছিলেন। তার দুঃখের কথা তিনি মিডিয়ায়ও অনেকবার বলেছেন। কোনো দেবদেবীর অভিশাপে তিনি দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন বলেও উল্লেখ করেছেন। ক্ষমতা হাতে নেয়ার পর সর্বপ্রথম কাজ হিসেবে তিনি নিজের করফাঁকির মামলাগুলো ডিসমিস করিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন।
আসলেই কি হাঁফ ছাড়তে পারলেন?
শপথ গ্রহণের সময় তিনি কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। চোখেমুখে ভয় এবং প্রচণ্ড স্ট্রেসের চিহ্ন। তার মতো একজন পোঁড় খাওয়া মানুষের জন্য এটি বেমানান। জীবনে তিনি বহু উচ্চপদে আসীন হয়েছেন, বহু দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে গিয়ে তিনি অনেকটাই হতবিহ্বল ছিলেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নাম দিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের কাজটি যে প্রচণ্ড ঝুঁকির সবসময়ই তার মাথায় ছিলো। এ দায়িত্ব নিতে তিনি বাধ্য ছিলেন। অ্যামেরিকার হাতে বিকল্প কেউ ছিলো না। যাদের টাকায় আন্দোলন হয়েছে, সেই জামায়াতকে সরাসরি পদে বসিয়ে দিলেও গণ্ডগোল হতো। ড. ইউনূস এখানে সাময়িক ড্যাম্পার হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের আদ্যোপান্ত না জানলেও এটি জানতেন এভাবে দায়িত্ব নেয়া আইনসিদ্ধ হচ্ছে না। তিনি একটি ফাঁদে আটকে গেছেন। স্পষ্টতই গত ৩ সপ্তায় দেশে আইন-শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। ড. ইউনূসের কোনো ভূমিকা কোথাও দৃশ্যমান নয়। জেল ভেঙ্গে কয়েদিদেরকে মুক্ত করার মতো কাজ ঘটছে, তিনি সেটিও ঠেকাতে পারছেন না। তার ভূমিকা যে শুধু একটি পুতুল দেশবাসীও ইতিমধ্যে কমবেশি বুঝতে পেরেছে। ড. ইউনূসের জন্য দুঃখজনক হলেও এই ফাঁদ থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় তার নেই। আর সাথে যারা উপদেষ্টা হয়েছেন, তাদেরও নেই। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে তারা মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য দেশদ্রোহী।

তবে ড. ইউনূসসহ এই উপদেষ্টারা বেশিদিন থাকতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। পরবর্তী ধাপে যারা আসছে, তাদেরকে সাংবিধানিক দায়মুক্তির প্রশ্নটি ইতিমধ্যেই সামনে চলে এসেছে। সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে যদি কোনোভাবে সেটি করা যায়, সে চেষ্টাও চলছে। তবে ফরহাদ মজহার, আলী রিয়াজসহ এদের বুদ্ধিজীবীমহল ইতিমধ্যেই বুঝে ফেলেছে তারা যে অন্যায় করেছে এবং করতে যাচ্ছে, সংবিধানের দুয়েকটি ধারা পরিবর্তন করে সেটি আইনসিদ্ধ করা সম্ভব নয়। সংবিধানের কোন ধারা কিভাবে সংশোধন করতে হবে, তা ১৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে দেয়া আছে। সেখানে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ভোট থাকতে হবে। তবে সেটিই শেষ কথা নয়। এমনকি সংসদের সবাই চাইলেও সংবিধানের কিছু কিছু বিষয় কোনোভাবেই সংশোধন করা যাবে না। এটি সংবিধানের সেলফ-প্রটেকশনের জন্যই করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৭খ অনুসারে, “সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।”
কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যাবে না, এরকম বিষয়সমূহের মধ্যে আছে প্রজাতন্ত্রের মূলনীতি ও পরিচয়, দ্বিতীয় অংশে আছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, তৃতীয় ভাগে আছে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, আর ১৫০ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে স্বাধীনতার ঘোষণা জাতীয় কিছু মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সংরক্ষণ। অর্থাৎ কেউ চাইলেও সংবিধানের এ মূল বিধানগুলো কোনোভাবেই পরিবর্তন করতে পারবে না। এ কারণেই সংবিধানকে একেবারেই বাদ দিয়ে পুনর্লিখনের চিন্তাভাবনা করছে তারা। সোজা ভাষায় যাকে বলা যায়, বাংলাদেশের সংবিধানকে পুরোপুরি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা করবে তারা।
নতুন একটি সংবিধান করা হলে দেশটিকে আর বাংলাদেশ বলা যাবে কি না, সে প্রশ্ন আসবে। নতুন একটি সংবিধান করা হলেও তারা কোনোভাবেই দায়মুক্তি পাচ্ছেন না। তারা বর্তমান সংবিধানকে সমুন্নত রাখার শপথই নিয়েছেন। আবার তারা যখন ক্ষমতা দখল করেছেন, তখনও বর্তমান সংবিধানই বলবৎ ছিলো। এই সংবিধান অনুসারে তারা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তির মতো অপরাধ করেছেন।
তবে তাদের হাতে একটি মাত্র বিকল্প ছিলো হয়তো সেনাবাহিনীকে দিয়ে আগে সংবিধানকে স্থগিত করা, অর্থাৎ সেনাশাসন জারি করা। এরপর কাঁঠালের আমস্বত্ত হিসেবে সংবিধান বাতিল থাকা অবস্থায় সেনাপ্রধানের হাতে শপথ নেয়া। ভবিষ্যতে যখন তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে, তখন আর্গুমেন্টের জন্য একটি পথ হয়তো খোলা থাকতো।
সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহিতার যে ফাঁদে পড়েছে ড. ইউনূস ও তার উপদেষ্টারা, তাতে তাদের ঘুমের ঘন্টা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে, এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়।…