New York Bangla Life
বাংলাদেশবিশেষ প্রতিবেদন

সুরতহালে হত্যাকারী ‘কোটাবিরোধীরা’, রিমান্ডে আনিসুল-সালমান


আওয়ামী লীগে আসার আগ থেকেই সালমান এফ রহমানকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনার শেষ ছিল না। তবে শেখ হাসিনা সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একজন সজ্জন ব্যক্তি।

তাদেরকে যেভাবে গ্রেপ্তারের কথা বলা হয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না এ কারণে যে, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ-জামান একই দিন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, জীবন নিয়ে ঝুঁকি ছিল, এমন অনেককে সেনাবাহিনী আশ্রয় দিয়েছে।

আরও বড় প্রশ্ন হল যে মামলায় তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে, সেখানে তাদের দূরতম সম্পর্ক থাকার কথা কি?

গ্রেপ্তরের পর দুজনকে আদালতে তোলা হয়েছে, বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আদালত চত্বরেই তাদের ওপর ডিম ছুড়ে মেরেছে। তারা ক্ষুব্ধ, সেটা করেছে, কিন্তু আদালতে তাদের পক্ষে আইনি লড়াই করতে দেওয়া হয়নি কোনো আইনজীবীকে। একতরফা বিচার করার ইঙ্গিত মিলল কি?

সালমান ব্যবসায়ী, তার বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারি থেকে অর্থ সংক্রান্ত অনেক অভিযোগ আছে আগে থেকেই, অন্যদিকে আনিসুল হক দেশের প্রথিতযশা আইনজীবী, তিনি দলীয় রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, এমনটা কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু তাদেরকে ফাঁসানো হয়েছে গত ১৬ জুলাই সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষে একজনের প্রাণহানির ঘটনায়।

সেদিন এই এলাকায় মারা গিয়েছিলেন মোট দুজন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ কর্মী সবুজ আলী, অন্যজন ছিলেন এটা ওটা করে জীবন চালানো মো. শাহজাহান।

পুলিশের প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেই সে সময় লেখা হয়েছিল, এই দুইজনকে হত্যা করেছে কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীরা। সাক্ষীর বয়ানও ছিল সেই প্রতিবেদনে।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সব পদ যেমন পাল্টে যাচ্ছে, তেমনি পাল্টে গেল পুলিশের এই ভাষ্যও। সেই ঘটনায় এখন ইন্ধনদাতা হয়ে গেলেন শেখ হাসিনা সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও বেসরকারি খাত ও শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।

অথচ দুজনের মৃত্যুই হয়েছে এমন জায়গায়, যেখানে কোটাবিরোধীরা দিনভর অবস্থান ধরে রেখেছেন। আর সেদিনই প্রথমবারের মত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা যায় ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের।

সেদিন মোট ছয় জন নিহত হয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে ঘিরে হলেও চট্টগ্রামে এক ছাত্রদল নেতাসহ তিনজন আর ঢাকায় দুই জনের মৃত্যু হয়।

আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তার দেখিয়ে পরের দিন আদালতে তোলা হয় ঢাকায় এই দুই জনের প্রাণহানির ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ নিয়ে।

পুলিশ তাদেরকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে আর একতরফা শুনানিতে সেই আদেশ মেনেও নেন ঢাকার মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদ।

সরকার পতনের পর থেকে আদালতে বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টদের সব আবেদন গ্রহণ হয়ে যাচ্ছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে, চট্টগ্রামে শিবিরের কুখ্যাত সন্ত্রাসী নাছিরের মুক্তি পেতেও সময় লাগেনি।

আনিসুল ও সালমানের বিরুদ্ধে মামলায় তাদের পক্ষে শুনানিই করা যায়নি। তাদের পক্ষে কয়েকজন আইনজীবী ওকালতনামা জমা দিতে গেলে বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীদের তোপের মুখে তারা আদালত ছেড়ে চলে যান।

পুলিশের আবেদনে বলা হয় ১৬ জুলাই ঢাকা কলেজের সামনে হতাহতের এই ঘটনায় ‘ইন্ধনদাতা’ ছিলেন এই দুই জন।

কিন্তু সেটি কি আসলে হওয়ার কথা। সেই মামলা কিন্তু করা হয়েছিল আরও আগেই। সেখানে পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে কী ছিল, তা কিন্তু গণমাধ্যমেই ছাপা আছে।

দুজনের মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ লিখেছে, কোটা আন্দোলনকারীদের মারধর ও আঘাতে ওই দুজনের মৃত্যু হয়।

নিহতদের মধ্যে সবুজ আলী  ঢাকা কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতেও যুক্ত ছিলেন।

আর মো. শাহজাহান নিউ মার্কেটে হকারি এবং দিনমজুরিও করতেন। তাকে ছাত্রলীগ কর্মী ভেবে আন্দোলনকারীরা মারধর করেছে বলে সুরতহাল প্রতিবেদনে মন্তব্য করে পুলিশ।

শাহজাহানের ডান চোখের নিচে একটি ছিদ্রের মত জখমের কথা বলা হয়েছে সুরতহালে। তার ভাই শাওন মনে করছেন, সেটি গুলির চিহ্ন হতে পারে।

অস্বাভাবিকভাবে কারও মৃত্যুর পর মৃতদেহের দৃশ্যমান অবস্থা বর্ণনা করে পুলিশ যে প্রতিবেদন তৈরি করে, সেটাকেই সুরতহাল প্রতিবেদন বলা হয়।

সবুজ আলীর সুরতহাল প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন নিউ মার্কেট থানার উপ পরিদর্শক মাহবুব আলী। কারা সবুজকে আঘাত করেছে, প্রতিবেদনের সে অংশ লেখায় কাটাকাটি করায় অস্পষ্ট।

তিনি লিখেছেন, “ঢাকা কলেজের সামনের পাকা রাস্তায় বিকেল সোয়া ৪টার দিকে কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে দিতে অজ্ঞাতনামা ছাত্ররা ভিকটিমকে”… এ পর্যন্ত পড়া যায়। এরপর কী ঘটেছিল সে অংশে কাটাকাটি হওয়ায় লেখা পড়া যায়নি।

পরে এসআই মাহবুব আলী সাংবাদিকদেরকে বলেছিলেন, যেটি বোঝা যায় না, সেখানে তিনি লিখেছিলেন, “বিষয়টা হচ্ছে কোটা আন্দোলনকারীদের ভিকটিমকে (সবুজ আলীকে) আঘাত করলে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে ডাক্তাররা মৃত ঘোষণা করেন।”

হকার শাহজাহানের সুরতহাল প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন এসআই কামালউদ্দীন মুন্সী। সেখানে দেহের ক্ষতের বর্ণনা দিয়ে লেখা ছিল, “তার মাথার পেছনে হালকা ফোলা আছে। ডান চোখের নিচে একটি সরকারি ব্যান্ডেজ আছে, তার নিচে একটি ছিদ্র জখম আছে। নাকে রক্তাক্ত জখম আছে।”

সুরতহাল প্রতিবেদনে সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও মৃত্যুর প্রমাণপত্রের বরাতের কথাও উল্লেখ আছে।

এসআই কামালউদ্দীন সেই প্রতিবেদনে লিখেন, “বিকেল পৌনে ৬টার দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে দিতে এসে ভিকটিমকে ছাত্রলীগ ভেবে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়িভাবে অতর্কিতে আঘাত করে।

“গুরুতর অবস্থায় প্রথমে পপুলার মেডিকেলে নিয়ে গেলে তারা উন্নত সচিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে রেফার করে। এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।”

শাহজাহানের ভাই মো. শাওন জানিয়েছিলেন, তার ভাইয়ের নাকের ডান পাশে একটি বড় ছিদ্র ছিল। সেটি গুলি লাগার কারণে এমন হতে পারে।

সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল বের হয়, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার।’ এ নিয়ে বিতর্ক হলে কিছুক্ষণ পরে স্লোগান উঠে, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’।

পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বিরোধীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়, এর প্রতিক্রিয়ায় পরদিন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা, চট্টগ্রামে মুরাদপুর এলাকাতেও সংঘর্ষ হয়, সেখানেই পাঁচ জনের প্রাণ ঝরে। সেদিনই দুই পক্ষ শক্তি প্রয়োগ করে।

সেদিন দুপুর ১২টার পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের অদূরে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। এতে মিরপুর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

দুপুরের পর থেকে শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। বিকাল ৪টার দিকে সংঘর্ষ ঢাকা কলেজ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

সে সময় ঢাকা কলেজের সামনের রাস্তায় হেলমেট পরা এক যুবককে রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। পাশেই লাঠি হাতে ছিলেন আরেক ব্যক্তি। পরে রাতে শনাক্ত হয় তিনি ছাত্রলীগ কর্মী।

শাহজাহান রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন ঢাকা কলেজের অদূরে মিরপুর সড়কে সিটি কলেজের সামনে রাস্তায়।

এই ঘটনায় মামলা হয়েছে আগেই, সরকার পতনের পর পুরনো এই মামলাতেই ঘায়েল করা হল আনিসুল হক ও সালমান রহমানকে।

এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের কট্টর সমালোচক ডেভিড বার্গম্যানও এই মামলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, “এই হত্যার ঘটনায় সালমান রহমান ও আনিসুল হকের সরাসরি জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ পাওয়া কঠিন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের সদস্য হওয়ার কারণে।”

বার্গম্যান বলেছেন, “এই ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মিথ্যা মামলা চলতেই থাকবে, যদি না পুলিশ এবং আদালতকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে আইন প্রয়োগের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়।”

তিনি বলেছেন, “হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের শাসনামলে এই দুই ব্যক্তি অপরাধ করে থাকতে পারেন। কিন্তু যথাযথ তদন্ত করে প্রমাণ সংগ্রহ করা উচিত এবং তার ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা উচিত।”

তিনি আরও বলেছেন, “বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সেক্রেটারি জানিয়েছেন, মানবাধিকার হবে তার প্রশাসনের মূলভিত্তি এবং দেশের প্রতিটি নাগরিকের সুরক্ষা সরকারের শীর্ষ অগ্রাধিকার।”

পোস্টের উপসংহারে বার্গম্যান লিখেছেন, “কোনও সরকার কীভাবে নিজের সবচেয়ে বড় হুমকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তা দেখে সেই সরকারের মূল্যায়ন করা হয়। এখন পর্যন্ত, এই ধরনের ফৌজদারি মামলাগুলো সরকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যদি এটি নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তাহলে নতুন সরকার মানবাধিকারের কোনও দাবি করতে পারবে না।”

Related posts

বিচারপতি নয়, ‘বিচারক’ বলতে হবে শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিককে

Ny Bangla

সাগর-রুনি হত্যা মামলার নথি পেল পিবিআই

Ny Bangla

ইউনূস ও হাসনাতদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযোগ

Ny Bangla

এবার মুজাহিদ-নিজামীর মতো হাসিনাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর মিশন!

Ny Bangla

আগামী বছর ভোটের জন্য অপেক্ষা বিএনপির, তারেকও দেশে ফিরবেন: মেজর হাফিজ

Ny Bangla

নির্বাচন কবে ? ।। কোন পথে বাংলাদেশ

saeimkhan

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Privacy & Cookies Policy