একজন সেনাপ্রধান নিষিদ্ধ দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন কোন এখতিয়ারে? সেনা মোতায়েন থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ গণভবন আর বঙ্গবন্ধু জাদুঘর রক্ষায় তিনি কেন পদক্ষেপ নিলেন না- দেরিতে হলেও উঠেছে প্রশ্ন।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
সরকার পতনের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের ভূমিকা নিয়ে এতদিন পরে হলেও অন্তত প্রশ্ন তুলেছেন একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, যে তিনটি প্রশ্নের জবাব তাকে একদিন না একদিন চুকাতেই হবে।
সরকার পতনের প্রায় দেড় মাস চলে গেছে, যে প্রশ্ন প্রথম দিনেই সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের মনে জেগেছে, সেই প্রশ্ন সেনাপ্রধানকে জিজ্ঞেস করা যায়নি, সেটি হল নিষিদ্ধ অবস্থায় জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক।
৫ আগস্ট এক ভয়ানক পরিস্থিতিতে বেলা ১১টার দিকে বেসরকারি টেলিভিশনের স্ক্রলে যখন লেখা হয়, সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যে শেখ হাসিনা উড়ে চলে যান ভারতে। বিকাল পৌনে ৫টায় সেনাপ্রধান এলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। বললেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন, ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, সর্বদলীয় সরকার হবে, নেতাদেরকে নিয়ে তারা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে যাচ্ছেন।
সেই বৈঠকে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন, সেই নামগুলো বলতে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নন, প্রথম নাম হিসেবে উল্লেখ করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের কথা।
সরকার পতনের প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল, এখন জামায়াতের আমির বা যে কারও সঙ্গে তিনি বৈঠক করতে পারেন, কিন্তু যে সময় এই বৈঠক হয়েছিল, সে সময় দলটি ছিল নিষিদ্ধ সংগঠন।
আন্দোলনে সহিংসতার সময় সন্ত্রাসী সত্তা আখ্যা দেয় ১ আগস্ট জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। সরকার পতন হোক আর যাই হোক, একজন সেনাপ্রধান কীভাবে অবৈধ সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেন, সেই প্রশ্ন সেদিনই উঠে। তবে সাহস করে কোনো সাংবাদিক তা জিজ্ঞেস করতে পারেননি।
পরে জামায়াতের আমির যান বঙ্গভবনেও, যা এক দিন আগেও ছিল অকল্পনীয়। সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকেও বাধ্য করেছেন অবৈধ সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করতে।
তিন দিন পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়, সেই শপথ অনুষ্ঠানেও অবৈধ ও নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন বঙ্গভবনে উপস্থিত ছিল, এটি ইতিহাসে লেখা থাকবে।
সবার মুখ যখন চুপ, তখন তিনিই প্রসঙ্গটি টানলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মুক্তিযোদ্ধা জেড আই খান পান্না।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের টক শো মুক্তবাকে এসেছিলেন এই আইনজীবী। সাহসী উচ্চারণে বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলাম তো তখনও বেআইনি। সেই সংগঠনের সঙ্গে সেনাপ্রধান কীভাবে বসে?
তাকে (জামায়াত) তো আগে বৈধ করতে নিতে হবে। একটা অবৈধ সংগঠনের সঙ্গে সে কীভাবে বসে?’
বৈঠকে উপস্থিত একটি রাজনৈতিক দলের নেতা জানিয়েছেন, সেই বৈঠকে সেনাপ্রধান সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন জামায়াতের আমিরকে। গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো যখন ভেঙে, পুড়িয়ে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে, তখন সেনাপ্রধান জামায়াত আমিরের কাছে আকুতির মত করে বলেছেন, ‘এবার আপনাদের ছেলেদেরকে তুলে নেন।’
পরে সাংবাদিকদের সামনে এসে সেনাপ্রধানের জামায়াত নেতার নাম প্রথমে নেওয়ার বিষয়টি আরও অপছন্দ জেড আই খান পান্নার। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিন মির্জা ফখরুলের কথা তো বলেনি, প্রথম তার মুখ থেকে বের হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের কথা। এরপর মামুনুল হক (হেফাজতে ইসলামের উগ্রবাদী নেতা), এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?’
সেনাপ্রধান কোনো কর্তৃত্ব বলেই এটা করতে পারেন না- আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই মত দেন এই আইনজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘জামায়াত তখনও আইনি সংগঠন না, তিনি কোন এখতিয়ারে বসলেন?’
জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ইউনূস সরকার তুলেছে ২৮ অক্টোব। অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে নীতি নির্ধারণী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারে কিনা, এটিও অবশ্য প্রশ্নের বাইরে নয়। সেই প্রশ্নের জবাবও একদিন ইউনূস সরকারকে দিতে হবে।
৫ অক্টোবর সেনাপ্রধানের আরও দুটি নিষ্ক্রিয়তার জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে বলে মনে করেন জেড আই খান পান্না। এগুলো হলো গণভবন লুট এবং ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে যে স্মৃতি জাদুঘর হয়েছে, সেটিতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ।
সরকার পতনের বিকালে একদল মানুষ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ঢুকে মাছ, হাঁস, কুকুর থেকে শুরু করে ফলের টব, অস্ত্রশস্ত্রও লুটে নেয়। এই বাসভবন কিন্তু শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নয়, যদি ওয়াকার উজ-জামানও প্রধানমন্ত্রী থাকতেন, তিনিও সেখানেই উঠতেন।
সেনাবাহিনীর পক্ষে এই লুটপাট ঠেকানো কোনো ঘটনাই ছিল না। কিন্তু ভিডিওতে বরং দেখা গেছে মানুষকে ভেতরে ঢুকতে একদল সেনা যেন উৎসাহ দিয়েছেন।
জেড আই খান পান্না প্রশ্ন রাখেন, ‘বঙ্গভবন কিন্তু লুটপাট হয়নি, হোয়াই গণভবন।…অন্যান্য মন্ত্রীদের বাসাবাড়ি পোড়ালেন কেন?’
তৃতীয় যে প্রশ্নটি তিনি রেখেছেন, সেটি হল, ‘৩২ নম্বরের যে বাড়িটা পোড়ালেন কেন? এটা তো শেখ হাসিনার না, ট্রাস্টের বঙ্গবন্ধু জাদুঘর। পোড়াল যারা, কেউ তো বাধা দিল না।’
সরকার পতনের পর পুলিশ বাহিনী সড়ক থেকে উধাও হয়ে গেলেও সেনা সদস্যরা রাজপথে ছিল। কিন্তু তারা এখানেও হস্তক্ষেপ করেনি।
জেড আই খান পান্না বলেন, ‘পুলিশ ছিল না ঠিক, কিন্তু সেনাবাহিনী মুভ করল না কেন?’
৩২ নম্বরের এই বাড়িটি ‘আমাদের সম্পদ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ওইখান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটা আসছে, ওইখান থেকে ৬ দফাটা আসছে, পাকিস্তান থেকে আমাদের যে পার্থক্যটা আসবে, সেটাও ওখান থেকে আসছে।’
এটা একটা ঐতিহাসিক বাড়ি উল্লেখ করে ভারতের মুম্বাইয়ে মালাবার স্ট্রিটে পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নার বাড়িটি অক্ষত থাকার উদাহরণ টেনে পান্না বলেন, ‘কই সেটা তো ধ্বংস করেনি।’
সেনাপ্রধান জবাবদিহিতার বাইরে নন, এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন জেড আই খান পান্না। তিনি বলেছেন, ‘জনগণের অর্থের দ্বারা এই দেশটাকে রক্ষা করার জন্য তিনি দায়িত্বে আছেন।’
দেশটাকে খাদের কিনারায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্নে কী জবাব দেবেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান?