ফাহমিদুল হক, শিক্ষক
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে রাজনৈতিক ময়দানে তিনি প্রায় অনুপস্থিত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পরে মৃত বঙ্গবন্ধুকে জাগিয়ে তোলা হয়, রাজনৈতিক আইকন হিসেবে পুনঃস্থাপন করা হয়।
তখন থেকে তো বটেই, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরে ওই আইকনের ছোট-বড় রেপ্লিকা ‘বিক্রি’ শুরু হয়। আশপাশের অন্যান্য সব চরিত্র (চার নেতা তো বটেই, জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জনগণকেও) ইরেজ করে দেয়া হয়। তাকে প্রয়োজনের চাইতে প্রকাণ্ড করে প্রজেক্ট করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর যে এত মূর্তি তৈরী হয়ে ছিল, আমার ধারণা ছিল না। ৫ই আগস্টে স্বৈরাচার পতনের পর বিবিধ ভাঙ্গাচোরায় নানান ধরনের বঙ্গবন্ধু মূর্তির পতনের দৃশ্য দেখলাম। বঙ্গবন্ধু পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় জবরদস্তি ছিল। প্রতি ক্লাসের টেক্সটবইয়ে, বঙ্গবন্ধু নিয়ে পড়তে হয়। ধড়িবাজ লেখক-প্রকাশক বইমেলায় বছরজুড়ে ঢাউস ঢাউস বই বের করেছেন বঙ্গবন্ধুর ওপরে, আর জনগণের টাকা পকেটে ঢুকিয়েছে।
অনুদানের নামে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছবি বানিয়েছেন ধান্দাবাজ নির্মাতারা। এসব হলো সময়ের গার্বেজ! নতুন নতুন আইনে ক্লজ ঢোকানো হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো সমালোচনা করা যাবে না। করলে ব্যাপক শাস্তি, সম্ভবত ন্যূনতম যাবজ্জীবন। আর ১৫ই আগস্টের শোক দিবসে থাকতো শোকার্ত হবার আদেশ, দিনমান দিবস পালনের অত্যাচার। করোনা এসে বছরব্যাপী শতবর্ষপালনের তছরুপাত কিছুটা কমিয়ে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকে আমি জাতির পিতা মানি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের আইকন। দেশের মুক্তিদাতা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পরে, তিনি প্রশাসক হিসেবে মোটামুটি ব্যর্থ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার চেষ্টা করেছেন, অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী হয়ে গণতান্ত্রিক নিয়মনীতি বাদ দিয়ে এক পার্টির শাসন কায়েম করার চেষ্টা করেছেন।
সমাজতন্ত্রের আগলি ভার্সন আমদানি করেছেন। তার নির্মম হত্যাকাণ্ডকে যেমন উচ্চমানের ষড়যন্ত্র হিসেবে বলতে হবে, তেমনি অল্প সময়ের মধ্যে ভীষণ অজনপ্রিয় হবার প্রেক্ষাপটও তারই দেয়া উপহার। কিন্তু আজ যেমন স্বৈরাচার হাসিনাকে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে পরাস্ত করা হয়েছে, তখনও তেমনই হতে পারতো।
কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা গিয়েছে খুনখারাবির পথে, এবং তখন থেকেই দেশের রাজনীতি পড়ে গেছে কুটিল আবর্তে। সিরাজ সিকদারসহ অনেক মানুষের হত্যার দায় বঙ্গবন্ধুর, কিন্তু যেকোনো পরিবর্তন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমেই হতে হয়। মিলিটারি ক্যু ও হত্যা হলো ক্ষমতা পরিবর্তনের নিকৃষ্টতম উপায়।
বঙ্গবন্ধু আমার কাছে কোনোদিনই দেবতা ছিলেন না। তাকে সমালোচনাসহই জাতিসত্তা গঠনে তার অন্যতম ভূমিকা আমি চিহ্নিত করি। আর শোকদিবসে বা অন্য কোনো উপলক্ষ্যে আমি কখনোই জবরদস্তির যাপন করি নি। অন্যদিকে তার মূর্তি ভাঙ্গায় আমি অবাক হই নি, তেমন দুঃখও পাইনি।
কারণ একপাক্ষিক পবিত্র এক ন্যারেটিভ দাঁড় করানো হয়েছে, সেই ন্যারেটিভের ভিত্তিতে একটি প্রশ্নহীন আনুগত্যনির্ভর আইকনকে নানান জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে: শহরের মোড়ে, বিদ্যাভবনে, পাঠ্যপুস্তকে… কোথায় নয়? আর সেই আইকনকে সামনে রেখে, করা হয়েছে যাবতীয় দুর্নীতি, নিপীড়ন, অপশাসন, সবমিলিয়ে এক স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে। তো স্বৈরাচার সরে গেলে, আইকনের ওপরে হামলা হবে, এটা অস্বাভাবিক নয়।
এটা আমি জনতার রোষ হিসেবে দেখতে চাই। কিন্তু আমি খুব দুঃখ পেয়েছি বঙ্গবন্ধু যাদুঘর বা ৩২ নম্বর পুড়িয়ে দেয়ায়। আমাদের দেশে আর্কাইভিং বা সংরক্ষণে অবহেলা করা হয়, যাদুঘরগুলোতেও অযত্নের অভাব। একটা নতুন যাদুঘর, ইতিহাস ও সংস্কৃতির স্মারক। জার্মানিরা যত্নসহকারেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অপকর্মগুলো সংরক্ষণ করেছে।
’আত্মস্বীকৃত খুনি’ ও তাদের ফলোয়াররা একটা যাদুঘরকে ছেড়ে দিতেই পারতো। এটা আমি জনতার রোষ নয়, বরং পূর্বের অপরাধী ও তার অনুসারীদের অপরাধের স্মারক সরিয়ে ফেলা হিসেবে দেখতে চাই।
বঙ্গবন্ধুকে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি ও তৎসংশ্লিষ্ট জবরদস্তির একটা ভালো ফল অবশ্য পাওয়া গেছে এই আন্দোলনেই, বা আন্দোলন-পূর্ববর্তী প্রতিরোধে। নতুন প্রজন্ম একমুখী হলেও, দেশের ইতিহাস জেনেছে, এবং দেখেছে বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধ চেতনার ঠিক বিপরীত কাজই করছে হাসিনা সরকার।
হাসিনাকে উৎখাতের চিন্তা ও রসদের কিছুটা বঙ্গবন্ধুই সরবরাহ করেছেন। কিছ ভোকাবুলারি সেখান থেকেই ধার করেছে আন্দোলনকারীরা। আর বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়েও জেনেছে তার গণমুখী প্রতিরোধ ও আন্দোলনের চিন্তা ও কর্মকাণ্ড।
যেমন, তার বইতে আছে, ”একটি শক্তিশালী বিরোধীদলের অনুপস্থিতে গণতন্ত্রের বিকাশ ব্যাহত হয়।” আর বাস্তবে দেখা গেছে তার মেয়ে বিরোধীদলশূন্য করে ফেলেছে বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুর কাছে নতুন বাংলাদেশও ঋণী।
আগে কখনো করিনি, স্বৈরাচারপরববর্তী মৃত্যুদিবসে তাকে স্মরণ করি।