গালিবা ইয়াসমিন,
ছবির ভাইটির নাম মাহফুজ আলম। যাকে বলা হচ্ছে ২৪ এর আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড এবং সমন্বয়কদের সমন্বয়ক। যার সম্পর্কে এতদিন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া কিছুই জানতে পারেনি। ব্যর্থ হয়েছে বিগত সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র DGFI বা NSI এর মত গোয়েন্দারাও।
জুলাই বিপ্লবের এর শুরু থেকেই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এক নতুন ধরণের আন্দোলন কাঠামো তৈরী করতে করতে এগিয়েছে। যার সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অংগন কখনোই পরিচিত ছিল না।
সাধারণত যেকোন আন্দোলন আহবাহক কমিটি দ্বারা পরিচালিত হলেও এইবারের আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ডিকশনারিতে যোগ করেছে নতুন শব্দ ‘সমন্বয়ক’। এরপরে একের পর এক যোগ করেছে আরো নতুন নতুন টার্মিনোলজি- ‘বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট শাটডাউন, মার্চ ফর ঢাকা’ এই ধারণাগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অংগন আগে কখনো দেখেনি।
ছয় সমন্বয়ক ডিবি হেফাজতে, তবুও আসতে থাকে একের পর এক কর্মসূচি। জীবন কে তুচ্ছ করে তাতে যোগ দেয় আপামর ছাত্র জনতা। সফল হতে থাকে প্রতিটা কর্মসূচি। কিভাবে কে কোথায় বসে তৈরী করত এই রূপরেখা?
এই চিন্তা আমার মাথায় তখন থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সম্প্রতি ড. ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেব নিয়োগ প্রদান করে মাহফুজ ভাইকে প্রকাশ্যে আনার মাধ্যমে সেই জট টা খুলতে শুরু করেছে।
কেনো দরকার ছিল এই নতুন ধারণাগুলো? আর কেনই বা এই ধারণাগুলোর সাথে দলমত নির্বিশেষে সকলে মিশে গিয়েছিলো?
আর কেনই বা অতীতের অনেক রাজনৈতিক দলগুলো বারবার হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন, সরকার পতন সহ নানা আন্দোলনের ডাক দিয়েও সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছিল?
এই প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে আমার অবজারভেশন হলো, পূর্বের দলগুলোর ভুল সময়ে ভুল ডাক এবং জনগণের স্বার্থে না দাঁড়িয়ে তাদের দলীয় স্বার্থে দাঁড়ানো। যার কারণে জনগণ এই আন্দোলনের ডাককে তার নিজের আন্দোলনের ডাক মনে করেনি।
এই কারণেই আন্দোলন গুলো বাঁধা পড়েছিল তাদের দলীয় গন্ডির ভেতরেই। বার বার হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন, সরকার পতন এই শব্দগুলো শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষের এইগুলোর উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল।
সাধারণ জনগণ যখন দেখে হরতালে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক থাকে, অসহযোগ আন্দোলনে সব অফিস আদালত খোলা থাকে, সরকার পতনের ডাকের পর সরকার অবলিলায় টিকে যায় আর প্রতিপক্ষকে নিয়ে রং তামাশা করে বিবৃতি দেয়।
তখন এই শব্দগুলো আর সরকারকে ভীতি জাগাতে ব্যর্থ হচ্ছিল আবার জনগণের ভিতরে আশা জাগাতেও সমান ভাবে ব্যর্থ ছিল।
তাই দরকার ছিল নতুন শব্দ, নতুন ধারণার। যেই শব্দগুলোতে সুর মেলাবে সব শ্রেণীর মানুষ, যেই ধারণায় অংশ নিবে ছেলে বুড়ো থেকে সব জনতা। আর এই শব্দ এবং ধারণাগুলো ছিল এই মাহফুজ আলম ভাইয়ের ব্রেইন চাইল্ড।
বর্তমান সময়কে বুঝার ক্ষেত্রে উনি যেকোন রাজনৈতিক দলের চেয়ে অধিকতর প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। সঠিক সময়ে সঠিক কর্মসূচি এবং পুরনোকে ভেংগে নতুন কাঠামো তৈরী যাতে সবাই ইনক্লুডেড ফিল করে, এই ক্ষেত্রে উনি শতভাগ সফল।
মাহফুজ আলম ভাই আমার হলের আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র। আমাদের সবার পরিচিত ফেইস। চুপচাপ এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের মাহফুজ ভাইকে দেখতাম হলের পুকুর পাড়ে বসে থাকতে, চুপচাপ জামাই এর দোকানে খাবার খেতে।
দীর্ঘ ৬-৭ বছরের হল জীবনে কখনোই আলোচনায় আসার মত কিছু বলতে বা করতে দেখে নি কেউ। কিন্তু হটাৎ ই আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অংগনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসলেন। লম্বা ঝাকড়া চুলের চেহারায় ষাটের দশকের বিপ্লবী সিরাজুল আলম খানের অবয়ব কিছুটা লক্ষ্যণীয় ছিল।
ষাটের দশকে যখন রাজনৈতিক দলগুলো স্বায়ত্তশাসন এর দাবি মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে ভয় পেত সেই সময়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা সিরাজুল আলম খান চৌধুরীরা এই জহুরুল হক হল (তৎকালীন নাম ইকবাল হল) কে কেন্দ্র করেই গড়ে তুলেছিলেন গোপন সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ যাদের কে ইতিহাসে আমরা নিউক্লিয়াস নামে চিনি।
সেই হলেই আবারো এক ঝাকড়া চুলের যুবক আসবে, যার মাথার ক্ষুরধার বুদ্ধিতে কবর রচনা হবে প্রবল পরাক্রমশালী এক ফ্যাসিস্ট রেজিমের। পুকুর পাড়ে আনমনে বসে থাকা, অন্তুর্মুখী স্বভাবের এই মানুষটাকে যারা আমরা চোখের সামনে দেখতাম, তারা কি এটা ক্ষুণাক্ষুরেও ভেবেছিলাম!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসলেই এক আজব জায়গা! আগে ইতিহাস পড়তে গেলে এসব চোখে পড়ত, আর এবার চোখের সামনে নতুন ইতিহাস তৈরী করতে দেখলাম।
আমার কথাগুলোকে কেউ ইন্সটিটিউশনাল প্রাইড হিসেবে নিবেন না দয়া করে। এই আন্দোলনে প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটা স্কুল কলেজ, এমনকি নতুন ইতিহাস তৈরী করা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আত্মত্যাগ পুরো জাতিকে এক ছাতার নিচে এনেছিলো। এইটা আমি চোখ বন্ধ করে স্বীকার করি।
©Robiul Rafi