ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ফলে মন্ত্রী, এমপি এবং দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে গেছেন। অনেক নেতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন, আবার কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বর্তমানে কলকাতায় অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা।
কলকাতার হোটেল কর্মচারীদের মতে, পালিয়ে আসা নেতাদের মধ্যে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা রয়েছেন। অধিকাংশ নেতাই শহরের বাইরে থাকেন, কেউ কেউ হোটেল বা ভাড়া করা বাসায় আছেন। নিরাপত্তার কারণে তারা দিনের বেলা বের হন না, তবে রাতে বিভিন্ন স্থানে আড্ডা দেন। সীমান্ত পারাপারের জন্য তারা দালালের মাধ্যমে অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করে ভারতে প্রবেশ করেছেন।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতারা দেশত্যাগের জন্য যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, ফেনী, সিলেট, দিনাজপুরের হিলি এবং পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা সীমান্ত ব্যবহার করেছেন। এরপর তারা ভারতের ত্রিপুরা, আগরতলা, কলকাতা, আসাম এবং মেঘালয় রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। এসব জায়গা থেকে কেউ কেউ আরও দূরে—দুবাই, জার্মানি বা ইংল্যান্ডে পাড়ি দেওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে।
এই সীমান্ত পারাপারের জন্য একাধিক চক্র গড়ে উঠেছে, যারা বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে প্রভাবশালী নেতাদের পারাপারে সহায়তা করছে। জনপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ২৫-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত দালালদের দিতে হচ্ছে। তবে কিছু ব্যক্তি দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একটি অংশ ইতোমধ্যে দেশত্যাগ করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। এছাড়াও দেশত্যাগ করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, এবং নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ আরও অনেক নেতা।
এছাড়া, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, এবং সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ দলের আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার দেশত্যাগের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে তাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। একইভাবে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তিনি প্রথমে ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুরে যান, তবে তার পরিবার পৃথক ফ্লাইটে লন্ডনে গিয়েছে।
এদিকে এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, আলোচিত ডিবির হারুন অর রশীদ, বিপ্লব কুমার সরকারসহ অন্তত ২০ জন পুলিশ কর্মকর্তার হদিস নেই। তারাও দেশ ছেড়েছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। তা ছাড়া রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক ও শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়াসহ আরও কয়েকজন কলকাতাসহ ভারতের কিছু স্থানে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার কবির, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন নিখিল, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির (শয়ন), ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ, যুবলীগ নেতা জয়দেব নন্দীও পালিয়ে গেছেন। তার মধ্যে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন আছেন সিঙ্গাপুর। ইনান আছে কলকাতায়।
এই প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের তথ্যানুযায়ী শতাধিক নেতা ভারতের কলকাতায় আছেন। তাদের বিষয়ে আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছি। তারা কোন হোটেল বা বাসায় অবস্থান করছেন, সেই তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। কলকাতায় আমাদের সোর্স লাগানো আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নেতাদের মধ্যে বেশিরভাগই দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে পালিয়ে গেছেন। পালানোর জন্য তারা মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেছেন। তার মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, অসীম কুমার উকিল, অপু উকিলসহ অন্তত ৭০-৮০ জন সীমান্ত এলাকা দিয়ে পালিয়ে গেছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। যারা তাদের পালাতে সহায়তা করেছেন, তাদের চিহ্নিত করতে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে।’
নাম প্রকাশ না করে কলকাতার মারকুস ও সদর স্ট্রিট এলাকার কয়েকজন হোটেল কর্মচারী টেলিফোনে বলেন, ‘২ আগস্ট থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা কলকাতায় এসেছেন। ৫ আগস্টের পর এর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তারা নিউ মার্কেট, নিউ টাউন, মুকুন্দপুর, মারকুস স্ট্রিটসহ শহরের বাইরে অবস্থান করছেন। এ সংখ্যা একশর বেশি হবে। পর্যটকদের সংখ্যা অনেক কম কলকাতায়। কিন্তু নেতাকর্মীদের সংখ্যা বেশি।’
তারা আরও বলেন, ‘কলকাতার বাইরে অন্য প্রদেশে নেতারা এসেছেন বলে আমরা শুনেছি। তাদের ভিসা আছে। আমাদের হোটেলেও অনেক নেতাকর্মী আছেন। তারাও আমাদের জানিয়েছেন সীমান্ত এলাকায় অর্থ দিয়ে আমাদের আসতে হয়েছে। তবে তারা কৌশলে থাকেন। দিনের বেলায় তারা হোটেল থেকে তেমন একটা বাইরে যান না। রাতে বিভিন্ন স্থানে যান। তাদের অর্থের সমস্যা হয় না। তিন-চার মাসের আগাম ভাড়াও দিয়ে রেখেছেন কেউ। আমরাও তাদের সহায়তা করি। কারণ তারা আমাদের কাছে “মেহমান”।’
পুলিশের একটি ইউনিটের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই আওয়ামী লীগ নেতারা দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কেউ পালাতে পেরেছেন, আবার কেউ যেতে পারেননি। নেতাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও পালিয়ে যাওয়ার তালিকায় আছেন। কিছুদিন আগে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, গত সরকারের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ কয়েকজন নেতা কলকাতায় পালিয়ে গেছেন। তাদের ধরতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আসছিলাম। কঠোর নজরদারি ও নিরাপত্তার মধ্যে কীভাবে তারা দেশ ছেড়ে পালালেন, সেই তথ্য উদঘাটন করার চেষ্টা চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলন বানচাল করতে আসাদুজ্জামান খান ছিলেন বেশি বেপরোয়া। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক হত্যা মামলা হয়েছে। আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল, অপু উকিলসহ বেশ কয়েকজন নেতাও রয়েছেন কলকাতায়। তারা প্রায়ই কলকাতার ইকো পার্ক ও সায়েন্স সিটিতে ঘুরতে যান। গত শনিবার ইকো পার্কে তারা আড্ডাও দিয়েছেন।’
তিনি জানান, কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। এরই মধ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এমনকি পুলিশও তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করে। এ ঘটনার পর দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন সাধারণ লোকজন ও স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা। ১৬ জুলাই থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের গুলিতে প্রাণ হারান ১ হাজার ৫৮১ জন শিক্ষার্থী, নিরীহ লোকজন।
আবার দুর্বৃত্তদের হামলায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। তাদের হত্যা ও থানা-ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে বেশিরভাগ আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে। আওয়ামী লীগের লোকজন বৈধ ও অবৈধ অস্ত্রও ব্যবহার করেছেন। তারাও ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা-জেলা-উপজেলার নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্তা ও কিছু সম্পাদক আসামি হয়েছেন। তাদের ধরতে পুলিশ একটি তালিকা তৈরি করেছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিনই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
পুলিশ সূত্র জানায়, ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তারা টেন্ডারবাণিজ্য, দুর্নীতি করাসহ এমন কোনো কাজ নেই, যা তারা করেননি। নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর তারা দফায় দফায় হামলা চালিয়েছেন। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কম যায়নি। তারাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে নিরীহ শিক্ষার্থী এবং লোকজন মারা যান। অথচ সরকার পতনের পরপরই পালানোর পথ খোঁজেন তারা। মূলত জনরোষ থেকে বাঁচতে এবং গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে আছেন।
previous post
next post