গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে গণপিটুনির ৩৬টি ঘটনায় অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু এবং আরও ১৪ জনের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে সারা দেশে অন্তত ১৬ জন নিহত ও ৭০৬ জন আহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) তাদের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে।
এইচআরএসএস-এর মতে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে মানবাধিকার পরিস্থিতির কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতিতে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি দেখা যায়নি। বরং, কিছু ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) সেপ্টেম্বর মাসের মাসিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কয়েকটি গুরুতর সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে: আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা, রাজনৈতিক মামলা ও গ্রেপ্তার, সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ, শ্রমিক হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশি নির্যাতন ও হত্যা এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সমস্যাগুলো এখনো বহাল রয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং নিজেদের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা এইচআরএসএসের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, সেপ্টেম্বর মাসে কমপক্ষে ৮৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭০৬ জন। সহিংসতার ৮৩টি ঘটনার মধ্যে ৪৫টি ঘটনা ঘটেছে বিএনপির অন্তঃকোন্দলের কারণে, ২৩টি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে, ৫টি আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দলে ও ১০টি ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দলের মধ্যে। নিহত ১৬ জনের মধ্যে অন্তঃকোন্দলে আওয়ামী লীগের ১ জন ও বিএনপির ৮ জন নিহত হয়েছেন। বাকি ৭ জন নিহত হয়েছেন বিরোধী পক্ষের হামলায়। ১৬ জন নিহতের মধ্যে ১১ জন বিএনপির আর ৫ জন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক। সেপ্টেম্বরে ১১০ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৪৪ জনের মধ্যে ১৫ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু।
সেপ্টেম্বর মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বা হেফাজতে ৯ জন নিহত হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, সারা দেশে আধিপত্য বিস্তার এবং দুর্বৃত্তদের হামলায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের অন্তত ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এই সহিংসতায় আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো: কমপক্ষে ২৫০টি ঘরবাড়ি, যানবাহন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৬ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছে, যা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ২ জন পাহাড়ি নাগরিক নিহত হয়েছেন। আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় ১ জন শ্রমিক পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন এবং অনেকে আহত হয়েছেন।
অন্তত ১৮টি ঘটনায় ৯০ জন সাংবাদিক সেপ্টেম্বর মাসে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং অন্তত ২১ জন আহত, ২ জন লাঞ্ছিত, ৩ জন হুমকির শিকার ও ২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর কমপক্ষে ২টি হামলার ঘটনায় ১টি মন্দির ও ৪টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় মাজারে হামলা, ভাঙচুর, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৯০ জন। সেপ্টেম্বর মাসে ৩৪টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৭৬ জন। সীমান্তে বিএসএফের ৩টি হামলার ঘটনায় ২ জন বাংলাদেশি নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছেন এই সময়ে।
প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর এসব বিষয় বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে।

previous post