বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা এই পথ খুলে দিতে পারে। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সংগ্রাম করছে, তাদের ধৈর্য দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ভারতে উড়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনীতিতে তার শেষ দেখতে পেয়েছিলেন অনেকে। তবে দুই মাসে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার চরম অবনতি, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকারিতায় জনমত যে দ্রুত ঘুরছে, সেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন দল মত ও সংগঠনের মধ্যে মত পার্থক্য স্পষ্ট, ছাত্রদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আবেদন হারিয়েছে, সর্বোপরি সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য চোখে পড়ছে না। এর মধ্যে ইসলামী উগ্রবাদের বিস্তারের বিষয়টিও সামনে আসছে।
দেশের এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ তার ফেসবুক পেজে অরিচেই ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। আর বিষয়টি যে কেবল কথার কথা না, সেটি বোঝা যাচ্ছে টাইম ম্যাগাজিনের কভারেজেও।
টাইম একটি বড় লেখার শিরোনাম করেছে যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত
নেতা শেখ হাসিনার কীভাবে প্রায় অসম্ভব প্রত্যাবর্তন ঘটতে পারে’।
বিশ্বের প্রভাবশালী ম্যাগাজিনটি লিখেছে, শেখ হাসিনার প্রস্থানের পর কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা শূন্যতার কারণে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগকে সব স্তরে সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। হাজার হাজার পুলিশ পালিয়ে গেছে যাতে প্রতিশোধের শিকার না হয়। অন্তত ৪৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং জামায়াতে ইসলামী দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
কিন্তু হাসিনার প্রস্থানের পর উচ্ছ্বাস এখন বিতর্কে পরিণত হয়েছে, দেশের ভবিষ্যৎ পথ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
গত ৩১ সেপ্টেম্বর, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ স্কুলের পাঠ্যবই পর্যালোচনা কমিটি বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্তকে ‘উদ্বেগজনক ও বিপজ্জনক’ আখ্যায়িত করেছে। এই পদক্ষেপকে যা ইসলামী মৌলবাদীদের সঙ্গে একটি আপস হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এর প্রতিক্রিয়ায়, কট্টরপন্থি হেফাজতে ইসলামের নেতারা আবার এসব উদ্বেগকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে নিন্দা করেছে।
এই উত্তেজনাপূর্ণ, বিশৃঙ্খল এবং তিক্ত সময়কে ‘প্রকৃত গণতন্ত্রের লক্ষণ’ বলে দাবি করছেন সংস্কারকরা। শুরুতে তাদের প্রতি প্রবল জনসমর্থন থাকলেও এখন নতুন নির্বাচনের দাবি আর জোরালো হচ্ছে।
নরওয়ের ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি গবেষক মুবাশার হাসান বলেছেন, ‘এই সরকার বৈধতা পেয়েছে, জনগণের সমর্থন আছে, কিন্তু তাদের জনপ্রিয় ম্যান্ডেট নেই।’
সংস্কারকরা আসলেই একটি জটিল পরিস্থিতিতে আছেন। অর্থবহ সংস্কার বাস্তবায়ন করতে এবং যারা নির্যাতনের জন্য দায়ী তাদের জবাবদিহি করতে সময় লাগবে। তবে একটি দিশাহীন দেশে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সংগ্রাম করছে, তাদের ধৈর্য দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।
গত সপ্তাহে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সাম্প্রতিক বন্যার কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬.৬ শতাংশ থেকে ৫.১ শতাংশে কমিয়ে দিয়েছে।
যদি অস্থিরতা ও স্থবিরতা অব্যাহত থাকে, তবে বিপর্যস্ত জনগণ হাসিনার রেকর্ডের দিকে আরও সদয় দৃষ্টিতে তাকাতে পারে বলে মনে করছে টাইম।
গত দশকে বাংলাদেশ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দ্রুততম বিকাশমান অর্থনীতি ছিল, যেখানে জিডিপি ২০০৬ সালে ৭১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সালে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে ।
এই পরিস্থিতির বিবেচনায় উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান মত দিয়েছেন, ‘শেখ হাসিনার ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই বাস্তবসম্মত’। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি দক্ষিণ এশিয়ায় শাসক পরিবারের রাজনীতির ইতিহাস দেখেন, কখনই তাদের দলগুলোকে বাদ দেওয়া যায় না, এমনকি যখন তারা হেরে যায় বা দুর্বল অবস্থায় থাকে।’
মুবাশার হাসান অবশ্য মনে করেন, বিষয়টি এত সহজে ঘটবে না। বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে, শেখ হাসিনার পোস্টারগুলো বিকৃত করা হয়েছে এবং তাকে ‘স্বৈরাচারি’ আখ্যা দিয়ে দেয়ালে বিকৃত গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। তরুণদের একটি বড় অংশে এভাবেই শেখ হাসিনাকে চিত্রিত হবেন।
সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, হাসিনা নির্বাচনে দাঁড়াবেন কিনা সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবুও সবাই একমত যে, যদি অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়, তবে তার ফিরে আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
ঢাকার সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক এবং চ্যানেল আইয়ের টক শো-এর উপস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘আগামী দশ বছরে শেখ হাসিনা এবং তার দলের কোনো বড় ভূমিকা পালন করার সুযোগ নেই। তবে অবশ্যই এটি পরিবর্তিত হতে পারে যদি অন্তর্বর্তী সরকার ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়।’
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর-জেনারেল শহিদুল হক বলেছেন, ‘একটি রাজনীতি প্রবণ প্রশাসন সংস্কার বাধাগ্রস্ত করার জন্য সব রকমের কৌশল প্রয়োগ করছে। তারা এই সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। যদি দৃশ্যমান কোনো উন্নতি না হয়, তবে জনগণ ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে।’
জয় এটিই বিশ্বাস করছেন। তিনি বলেন, “যদি তারা (সরকার) এক বছর বা ১৮ মাসের জন্য দেশ চালাতে চায়, আসলে আমি মনে করি এটা আদর্শ। আজকে ‘আইনশৃঙ্খলাবিহীন অবস্থা’ এবং জনতা কার্যত উন্মত্ত হয়ে আছে’, এটি সেই পরিস্থিতির দিকেই (জনগণের ধৈর্য ধসে পড়া) ইঙ্গিত করে।”
এর মধ্যে ওয়াশিংটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে তারা সমর্থন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়া ইউনূসকে সাক্ষাৎ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংক-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও সম্পর্ক বজায় রাখতে বদ্ধ পরিকর।
শহিদুল হক বলেছেন, ‘অ্যামেরিকার সমর্থন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থিতিশীলতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’।
তবে যত বেশি সময় অচলাবস্থা চলতে থাকবে, তত বেশি সংশোধনবাদী কথকতা স্থান পাবে। হাসিনা সরকার দমন-পীড়নের সময় যে ভুল করেছে তা স্বীকার করেছেন জয়। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক না করে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, অন্তত অর্ধেক হত্যাকাণ্ড ‘সন্ত্রাসী’ দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল যারা সম্ভবত একটি ‘বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা’ দ্বারা সশস্ত্র ছিল।
মানবাধিকার সংস্থার এশিয়া বিভাগের উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি অবশ্য বলেছেন, জয়ের দাবির বিষয়ে প্রমাণ কম। বরং অনেক ভিডিও আছে, যেখানে দেখা যায় পুলিশ অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে ‘বিকল্প তথ্য’ প্রচার হওয়া খুব সহজ।
তবুও আওয়ামী লীগের জন্য একটি প্রধান বাধা হল সরকার পতনের পর প্রায় সব শীর্ষ নেতা আত্মগোপনে, অনেকে দেশ ছেড়েছেন, যার ফলে সাধারণ কর্মীরা প্রতিশোধের শিকার হয়েছে।
গবেষক মুবাশার হাসান বলেন, ‘সাবেক শাসক দলের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত একটি অনুভূতি রয়েছে যে শেখ হাসিনা যেভাবে চলে যাওয়া বিশ্বাসঘাতকতা ছিল।’
রাষ্ট্রের অর্থ লুণ্ঠনের যে একতরফা অভিযোগ এখন করা হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম বলছে, ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। জয়ের ব্যাংক হিসাব স্থগিত হয়েছে। তবে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেখান টাকা কোথায়? অভিযোগ করা খুবই সহজ।’
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘একমাত্র পথ হলো আওয়ামী লীগকে তাদের ভুলগুলো স্বীকার করা এবং একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলা, যারা নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।’
কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, নেতাদের ‘গণহত্যা’ এবং ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে’ দোষী সাব্যস্ত করা হলে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা উচিত।
তবে জয় এসব দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানো এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটিকে কীভাবে নিষিদ্ধ করবেন?’
আইনগতভাবে এটি সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, এমনকি যারা সংস্কারের কথা বলছে এবং যারা প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল, তারও নিশ্চিত নয় যে এটি জাতীয় স্বার্থের পক্ষে হবে কিনা।
জিল্লুর রহমান বলেন, “আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ‘দুর্বলতা’ হলো শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক ‘পূজা’। তারা শেখ মুজিবের মেয়ের বিকল্প কল্পনা করতে পারে না।”
বঙ্গবন্ধুর নাতি, অর্থাৎ জয়ের সম্ভাবনা কী- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যদি তিনি নিজেকে একটি গণমানুষের নেতা হিসেবে বাংলাদেশে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত নেই।
ওসলো-ভিত্তিক গবেষক মুবাশার হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, জয়ের প্রতি তরুণদের মধ্যে শ্রদ্ধা ও সম্পর্ক নেই এবং এই সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ।
অবশ্য জয় এখনও সিদ্ধান্ত নেননি তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করবেন কিনা। তবে তার বক্তব্যে এক ধরনের সায়ও আছে। তিনি বলেছেন, ‘আমার কখনও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে, কে জানে, তবে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি ‘
তবে পরিবারের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে হয়ত আরেকটি আলোচনার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।