সদ্য প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে এক সময় বিএনপির গাঁটছড়া বেশ শক্তিশালী। দলটির প্রথম মহাসচিব ছিলেন তিনি। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকারের সময় ছিলেন উপ প্রধানমন্ত্রী। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সময়ও ছিলেন শিক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ধানের শীষ প্রতীকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বদরুদ্দোজা চৌধুরী। সব মিলিয়ে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় বিএনপির সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক ছিল তার। শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সেই সম্পর্ক আর টেকেনি। কী এর পেছনের কারণ? চলুন জানা যাক-
বদরুদ্দোজা চৌধুরী মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুইবার জাতীয় সংসদের উপনেতা এবং একবার বিরোধী দলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে তিনি খালেদা জিয়ার সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। একই বছরের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশের ১৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব শুরু করেন। ওই সময় শপথ গ্রহণের আগে তিনি বিএনপির সব পদ ও দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।
বদরুদ্দোজা চৌধুরীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য, রাজনীতিতে তার অভিষেক ছিল নাটকীয়। কিন্তু বিএনপি থেকে তার প্রস্থান ছিল বিয়োগান্তক। কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে একজন ব্যতিক্রমী চরিত্র হিসেবে মনে রাখবে।
২০০২ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদত্যাগ করেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী। সেসময় বিএনপি সংসদে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিল। এর আগে বিএনপির সংসদীয় দলের বৈঠকে অনেক সংসদ সদস্য দাবি তোলেন, রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী যেন পদত্যাগ করেন, অন্যথায় তাকে ইমপিচ করা হবে।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র সাত মাস সাত দিনের মাথায় বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে কেন বিদায় নিতে হয়েছিল। এর নানাবিধ কারণ উল্লেখ করে তখনকার সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। যেসব কারণের কথা ওইসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে:
# জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সমাধিতে রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদন না করা।
# রাষ্ট্রপতির বাণীতে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা।
# বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাকে মুন্সিগঞ্জে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপতির ছেলে এবং সংসদ সদস্য মাহী বি. চৌধুরীর তোরণ নির্মাণ।
# রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন বক্তব্যে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ব্যবহার না করা; কারণ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বিষয়টি বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ধারণ করে।
# দলের মনোনীত হয়ে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়া।
# রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ব্যয় বাড়ানো।
# সেনাবাহিনীসহ কয়েকটি বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করেন রাষ্ট্রপতি।
# রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের বাইরে অধিক সংখ্যক জাতীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া।
# বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর হিসেবে তার দায়িত্ব পালন নিয়ে সরকারের একটি মহল থেকে আপত্তি।
বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পদত্যাগের পেছনে আরও কিছু কারণ জানা যায়। এর মধ্যে রয়েছে অধ্যাপক আফতাব আহমদকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর না করা। অধ্যাপক আফতাব আহমদের নাম প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর অনুমোদন করেছিল। রাষ্ট্রপতি সেই ফাইলে স্বাক্ষর না করায় পরবর্তীতে আফতাব আহমদকে বাদ দিয়ে অধ্যাপক জিন্নাতুননেসা তাহমিদা বেগমকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী বেশি সময় পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ তোলেন বিএনপির কিছু নেতা। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির কভারেজ কমিয়ে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বিটিভিকে বলা হয়েছিল, এমন খবর সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে।
অভিযোগ আছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য এক মাস আমেরিকায় অবস্থান করে দেশে ফেরার পর তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি খোঁজ-খবর নেননি বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদত্যাগের পর বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপি কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। এরপর ‘বিকল্পধারা বাংলাদেশ’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনি। তবে দলগঠনের পর দেশজুড়ে সংগঠনের কার্যক্রম বিস্তৃত বা জনপ্রিয় করতে পারেননি তিনি।
অবশ্য জাতীয় নির্বাচনের সময় বড় দলগুলোর সাথে জোটগঠনে ভূমিকা রেখেছে বিকল্পধারা বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটে যোগ দিয়েছিল বিকল্পধারা বাংলাদেশ। যদিও পরে সে ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সবশেষ, ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচন যেটিতে বিএনপি অংশ নিয়েছিল, সেসময় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির সঙ্গে যোগ না দেওয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও তার দল বিকল্প ধারা বাংলাদেশ।