কখনও মুক্তিযুদ্ধকে ‘ব্যর্থ’ বলা হচ্ছে, কখনও বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা নিতে হবে। অথচ বিপ্লবে তো সুস্পষ্টতা থাকার কথা! নাকি ক্ষমতায় বসার পর কাওয়ালি গেয়ে বিপ্লবকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়?
আরিফুল ইসলাম
পূর্ববর্তী বিপ্লবে আমরা দেখেছি সুনির্দিষ্ট উন্মুক্ত পথরেখা আর উদ্দেশ্য। সুপরিচিত কাণ্ডারি ও অগ্রসেনা। সেসব বিপ্লবের বক্তব্য ছিল একেবারে পরিষ্কার।
জুলাইয়ে আমরা দেখলাম আমলা হওয়ার আশায় লাইব্রেরিতে মুখ গুঁজে থাকা কিছু মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। তাদের বোঝানো হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষ মেনে নিলেই কর্মসূচি শেষ।’ কিন্তু সরকার অনড় ছিল। সময়ের পরিক্রমায় লাশ পড়েছে। এর জেরে সরকারের পতন চাওয়া হয়েছে। সপ্তাহ গড়িয়ে পক্ষ হয়, চাকরিপ্রত্যাশী আর জনগণের দাবি মিলেমিশে হয় একাকার।
সরকার বিদায় নেয়, আসে ‘বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ডাক’। কিন্তু সমন্বয়করা কি সরকার পতনের আগে জনগণকে রাষ্ট্রে কোনো ধরনের ’রেভ্যুলিউশনারি পরিবর্তনের’ আশ্বাস দিয়েছিলেন? প্রমাণ তো মেলে না! এখন যদি ‘স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও আনব’ ধরনের দেয়ালচিত্রের কথা আশ্বাস হিসেবে ধরে নেই, তাহলে কথা ভিন্ন।
বিএনপি, জামায়াতের একটা সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল। বামদের বক্তব্য ছিল। সরকার পতনের ‘শত শত’ কারণ নিয়ে রাজপথে তাদের সরব উপস্থিতি ছিল। বছরের পর বছর তারা প্রাণ দিয়েছেন। রক্ত ঝরিয়েছেন। তারেক রহমান ৩১ দফা দিয়েছেন। মৌলভিরা ইসলামি রাষ্ট্র চেয়েছেন। বামরা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কথা বলে আসছেন সৃষ্টিলগ্ন থেকে।
কিন্তু ক্ষমতায় আসীন হওয়া সমন্বয়করা হাসিনা আমলে চেয়েছিলেন কেবলই সরকারি চাকরির কোটা বাতিল। যখন লাশ পড়ল তখন সহানুভূতি চেয়ে জনগণকে রাস্তায় দাঁড়াতে, ঐক্যবদ্ধ হতে ডাক দেওয়া হয়। জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছেন ও সেইসব আকাঙ্ক্ষার কথাই উল্লেখ করেছেন, যেসব আকাঙ্ক্ষা গত ১৫ বছর কিংবা তারও আগে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধেরও আগে থেকে তারা ধারণ করে আসছিলেন।
মনে করিয়ে দিই, সেসব আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিল প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোই। দলগুলোকে নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকতে পারে। তারা সবসময় সঠিক কাজ করেনি- এমন অভিযোগও আনা যেতে পারে। কিন্তু তারা যৌক্তিক দাবিগুলোর কথা ক্রমাগত বলে এসেছেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, জেল-জুলুম-গুম-খুন হয়েছেন সেটা নিয়ে তো দ্বিমত নেই!
কিন্তু সমন্বয়করা ক্ষমতায় আসীন হওয়ার আগে কোন আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছিলেন?
আজকে সমন্বয়করা আমলাতন্ত্র ধ্বংসের কথা বলছেন, রাষ্ট্রের কাঠামো বদলের কথা বলছেন, তুলে ধরছেন আরও নানান আকাঙ্ক্ষা। জনতার চোখে দেখলে, সব আকাঙ্ক্ষাই হাজির হয়েছে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের পুরো মাস, আগস্টের প্রথম দিনগুলোতে রাষ্ট্র কাঠামোর নিয়ে কোন কোন সংস্কারের কথা সমন্বয়করা বলেছিলেন?
চার দফা, আট দফা, নয় দফা, ছয় দফা সব দফাতেই ছিল ’সরকারি চাকরিকে কেন্দ্র করে দাবি’, আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সহিংস প্রতিক্রিয়ার’ প্রতিবাদে দাবি।
সমন্বয়ক ক্ষমতায় বসে, রাষ্ট্রের প্রটোকল নিয়ে নতুন রাজনীতির গান গাইছেন। যে গান আরও বহু আগে গেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান, এরশাদ। পার্থক্য উর্দি থাকা আর না থাকা।
রাষ্ট্র ‘ফ্যাসিবাদ’ মুক্ত হয়েছে যদি বলি, একে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে গেছেন রাজনীতিবিদরা, অ্যাক্টিভিস্টরা।
আল জাজিরার এক রিপোর্ট যে ঝটকা দিয়েছে, ডয়চে ভেলে-নেত্র নিউজের রিপোর্ট যে ধাক্কা তৈরি করেছে, শেখ হাসিনা নামের পাথরটিকে টুকরো টুকরো করায় সেসব ছিল বড় বড় হাতুড়ির আঘাত। আর সেই সঙ্গে দল-মতের পার্থক্য নিয়েও প্রায় অভিন্ন রাজপথে সক্রিয় ছিল রাজনৈতিক দলগুলো। তারা হাসিনার পদত্যাগের পেছনে হাজারো দাবির কথা তুলে ধরেছেন।
এই জুলাই আন্দোলনেও সব মিলিয়ে অত শিক্ষার্থী নিহত হয়নি, যতজন কর্মী হারিয়েছে বিএনপি, জামায়াত এমনকি সিপিবিও (দুইজন)।
আন্দোলন জনসম্পৃক্তও হয়েছে তাদের উদ্যোগে। যাত্রাবাড়ীতে ছাত্রদের আন্দোলনে সহযোগিতা করেছে জামায়াত-হেফাজত। খাবার বিলি করেছে বিএনপি, জামায়াত।
অথচ পরিবর্তনের পরে যেন শুধু সমন্বয়কদের দাবিই দাবি! অথচ ছাত্রশক্তি, রাষ্ট্রচিন্তাসহ আজকে জুলাই আন্দোলনের রাহবার দাবি করা সংগঠনগুলোর কয়জন প্রাণ হারিয়েছে?
আন্দোলন চলাকালে যে কিশোরকে গ্রেপ্তার নিয়ে সরকারের ওপর মানুষ রীতিমতো ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিল, সেও ছিল শিবিরের কর্মী!
সরকার পতনের পরপরই বিএনপির সমাবেশ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার নির্বাচনের দাবি তুলছেন। তাকে টিপ্পনী কাটা হচ্ছে। অথচ রাজনীতির মাঠে এই পোড় খাওয়া মানুষটির অবদান লিখতে গেলে শেষ হবে না।
সমন্বয়করা জেলায় জেলায় সফর করছেন। ‘নতুন রাজনীতির’ কথা বলছেন। তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা মানা! ক্ষমতায় আসীন হওয়ার আগের এক মাস এবং পরের এই দেড় মাসেও তাদের চাওয়া, রোডম্যাপ সুস্পষ্ট না।
কখনও তারা সরকারের নেতা-মন্ত্রীর মতো বক্তব্য দিচ্ছেন, কখনও তারা বিরোধী দলের মতো সরকারকে চাপে রাখার কথা বলছেন। তাদের বক্তব্য নিয়ে ধোঁয়াশা এতটাই যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ফেসবুকে পোস্ট করে সমন্বয়কদের সমন্বয়কখ্যাত মাহফুজ আলমের লেখা পড়তে চেয়েছেন তার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য।
সমন্বয়করা চমৎকার চটকদার কথা বলছেন। মানুষ বিমোহিত হচ্ছে, সেখানে মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা নেই, লোডশেডিং নিয়ে কথা নেই, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ে কথা নেই। সংবিধান পরিবর্তনের কথা আছে, যেটা কি-না নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া করার সুযোগ নেই। অথচ এরা কেউই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন, এমনকি গ্রাম, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ে তাদের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত জনভিত্তি নেই।
সরকার পতনের পর যেটা হওয়া দরকার ছিল তা হল, ‘রাজনৈতিক জাতীয় সরকার’। প্রত্যেকটা নিবন্ধিত সংগঠনের তৃণমূল পর্যন্ত কর্মী-সমর্থক রয়েছে। আজকে ভোট হলে বিএনপির জয় হবে সেটি বিনা তর্কে মানেন অনেকেই।
রাজনৈতিক দলগুলোর আকাঙ্ক্ষা মূলত জনগণেরই আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষা তারা শোনেন ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে। কোথায় মানুষের কী প্রয়োজন তাদের জানা থাকে। সংকট মোকাবিলায় তারা সব কৌশল বোঝেন।
আজকে সরকারে বিএনপি, এমনকি জামায়াত থাকলেও তাদের চাপ দিয়ে ‘মব জাস্টিস’ বন্ধ করতে বাধ্য করা যেত। যেমন আজমীর জাতীয় সঙ্গীত বদলের বক্তব্যের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিবাদ গড়ে ওঠার জেরে জামায়াত বলতে বাধ্য হয়েছে তারা এই বক্তব্য ধারণ করে না।
কিন্তু সমন্বয়ক গোষ্ঠীর এগুলোর কোনোটাই নেই। তারা জেলায় জেলায় যেসব বৈঠক করছেন গুটিকয়েক শিক্ষার্থী নিয়ে, সেখানে কৃষক, শ্রমিক, জনতার অংশগ্রহণ নেই।
তৈরি পোশাকখাতের গুরুত্বপূর্ণ স্থান সাভার শিল্পাঞ্চল অস্থির। ব্যবসায়ীরা হাতজোড় করছেন। বিএনপির লোকজন রীতিমতো কাজকর্ম ফেলে সড়কে পাহারায় দাঁড়িয়ে গেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর এই সময়ে শিল্পাঞ্চলের পার্শ্ববর্তী এলাকার সমন্বয়ক শোনাচ্ছেন, ’আমরা আমলাতন্ত্র ধ্বংস করে দেব।’
আমি এই বক্তব্যকে সমর্থন করি, স্বাগত জানাই। কিন্তু ভাই, এই বক্তব্য তো প্রয়োগের বিষয়। সেটা আসিফ নজরুল পর্যন্ত পৌঁছে দিলেই হতো। লিখিতটা পত্রিকায়ও ছাপানো যেত। এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পোশাক খাতে শান্তি আনতে ভূমিকা রাখা।
ধামরাইতে দুটি মাজারে হামলা হয়েছে, সেখানে যাওয়া। সংখ্যালঘু বাড়িতে হামলা হয়েছে, সেখানে বিএনপির ইয়াসিন ফেরদৌস মুরাদ চলে যেতে পেরেছেন রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির কারণে। কিন্তু কোনো সমন্বয়ক যেতে পারেননি।
কখনও মুক্তিযুদ্ধকে ‘ব্যর্থ’ বলা হচ্ছে, কখনও বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা নিতে হবে। অথচ বিপ্লবে তো সুস্পষ্টতা থাকার কথা! নাকি ক্ষমতায় বসার পর কাওয়ালি গেয়ে বিপ্লবকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়?
বদলের কথা তো রাজনৈতিক দলগুলো বলে আসছিল। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর তোমরা কোন রাজনীতি নিয়ে হাজির হলে? এ কোন অন্ধকার গলি! নাকি পূর্বনির্ধারিত ছক ক্ষমতায় বসার পর ধীরে ধীরে খোলাসা হচ্ছে?যদি সবই পূর্বনির্ধারিত হয়, তবে আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে নিজেদের রাজনীতি হাসিলের জন্য রাস্তায় নামিয়েছিলে কেন?