ইমতিয়াজ মাহমুদ, লেখক
(১) তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি প্রসঙ্গটা এসেছিল এক বন্ধুর সাথে গল্প করার সময়। বন্ধু বললেন ওরে, এই মেয়েটা তো তোর আত্মীয় হয়। বিস্মিত আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কিভাবে? বন্ধু বললেন তোর বাপ তো ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন একসময়, সহকারী কমিশনার, ঊর্মি তাইলে তোর আত্মীয় হয়ে গেল না? ঐভাবে কেউ আত্মীয় হয় কিনা জানিনা, তবু মেনে নিলাম যে হ্যাঁ, ঠিক আছে। বাপের কলিগকে তো আমরা কাকা চাচা আঙ্কেল এইসব বলতাম, একেও তো তাইলে ফুপুই বলতে হয় আরকি।
না, আত্মীয়তার যে সূত্র আমার বন্ধু দিয়েছেন সেটা নিতান্তই ঠাট্টা। বরং মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে তাঁর আপোষহীন অবস্থান আমাকে মুগ্ধ করেছে- সেই সূত্রে তাঁকে আমার আত্মার আত্মীয় মনে হয়েছে। কেননা তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে এইরকম দৃঢ় অবস্থান চট করে আর চোখে পড়ে না। আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী ছিল, দুর্নীতি করেছে ইত্যাদি কারণে আওয়ামী লীগ কলঙ্কিত হয়, পতিত হয় সে ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে মুক্তিযুদ্ধ তো ম্লান হয় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিকে হয়ে যায়না।
আমার বন্ধুদের অনেককেই দেখলাম মেয়েটাকে বোকা দিচ্ছে। কেউ বলছে সরকারী চাকরী করে এইসব বলবে কেন; কেউ বলছেন মেয়েটা বোকা, কেউ বলছেন মেয়েটা বিপ্লবী নয় মোটেই এইরকম কতো কিছু। কারো গায়ে মুজিব কোট দেখলে আঁতকে ওঠেন এরকম এক বিপ্লবী আবার কায়দা করে ফেসবুকে লিখেছেন যে ঊর্মি নাকি আসলে ওর চেতনা থেকে এইসব বলেনি, এগুলি ওর কথা নয়, এটা নাকি পতিত স্বৈরাচারের দালালী ইত্যাদি। ভাবখানা যেন তিনি ঊর্মির মস্তিষ্ক সফর করে এসেছেন।
(২)
দেখেন, দৃশ্যতই মেয়েটা জানতো যে ওর আচরণ সরকারী চাকুরীর আচরণবিধির সাথে মেলে না। সে নিজেও বলেছে যে এর জন্যে তাঁর চাকরী চলে যেতে পারে, গেলে যাক। এইসব বুঝেই সে তার নিজের মনের কথাটা বলেছে। সাথে স্পষ্ট করে এটাও বলেছে যে ‘আমি হিপক্রিট নই’। এর মানে হচ্ছে যে সে নিজের কাছে সৎ থাকতে চেয়েছে, ভেবেছে এই কথাগুলি বলা নাগরিক হিসাবে তার দায়িত্ব সেইজন্যেই বলেছে। চাকরীর নিয়মে চাকরীতে সে শাস্তি পাচ্ছে, শাস্তি যে ওর হবে সেটা জেনেই বলেছে।
সরকারী কর্মকর্তা হয়েও আচরণবিধি কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগেও অনেকেই ভেঙ্গেছেন। আপনি সেইসব সেনা কর্মকর্তার কথা ভাবুন যারা একাত্তরের ২৬শে মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছেড়ে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। ওরা তো রীতিমত মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো অপরাধ করেছিল। এখন আপনি আমাকে বলেন, যেসব পাকিস্তান আর্মির কাপুরুষ সেনা কর্মকর্তা বাঙালী হয়েও একাত্তরে আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেছে (এরকম অনেক ছিল) ওরা তো আচরণবিধি মেনেছে। আপনি কাকে উত্তম বলবেন?
বেসামরিক কর্মকর্তাদেরও অনেকের নাম বলতে পারি যারা একাত্তরে এসডিও ছিল বা ম্যাজিস্ট্রেট ছিল বা ডিসি বা এডিসি ছিল, একাত্তরের মার্চে আচরণবিধি ভেঙে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কেউ আছেন যারা ট্রেজারি খুলে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তহবিলের জন্যে। অস্ত্রাগার খুলে রাইফেল দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে। এরা সকলেই আচরণবিধি ভেঙেছে। যুদ্ধে যদি আমরা না জিততাম তাইলে ওদের একেকজনের মৃত্যুদণ্ড হতো।
(৩)
অনুমান করি, একজন তরুণ মেধাবী কর্মকর্তা হিসাবে ঊর্মি তার পূর্বসূরি সেইসব কর্মকর্তার গল্প জানেন। ঊর্মি তার নিজের বিবেক বুদ্ধি থেকে তার সেইসব পূর্বসূরিকে অনুসরণ করাটাই হয়তো যুক্তিযুক্ত মনে করেছে। তাকে তো আমি দোষ দিতে পারি না। আমার পূর্ব প্রজন্ম যদি স্বাধীনতার জন্যে প্রাণ দিতে কণামাত্র দ্বিধা না করে তাইলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটা সরকারী চাকুরী হারানো তো জীবন উৎসর্গ করার মতো বিশাল কিছু না আরকি।
আপনারা যারা মেয়েটার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন, ওকে বোকা বলছেন বা ‘বিপ্লবী নয়’ বলছেন আপানদের অবস্থান আমি বুঝতে পারি। আপনারা মিডিওকার সাধারণ মধ্যবিত্ত, আপনাদের বুদ্ধিতে বা চেতনায় এইরকম সাহসী একটা মেয়েকে তো বোকা মনে হবেই। মেয়েটা আপনাদের বিপ্লবী স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যে তো এইসব করেনি, সে তার নিজের চেতনা থেকে এইসব করেছে। ওর চিন্তা ও আবেগ অনুধাবন করার মতো ইয়ে তো আপানদের মস্তিষ্কে নাই আরকি।
বোকা তো বটেই। এই পুঁচকে মেয়েটা তো বোকা বটেই। আমি কেবল আপনাদের মনে করিয়ে দিই, এইরকম বোকা ছেলেমেয়রাই কিন্তু পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যায়, মানুষের মুক্তির জন্যে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হয়। আপনাদের হিসাবে তো তাইলে রুমিকেও বোকা বলতে হয়, নাকি? আমেরিকার বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল, বুয়েটেও পড়তে পারতো, হিরোর মতো দেখতে, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল সামনে। বোকাটা কিনা গেছে দেশের জন্যে প্রাণ দিতে। বোকা নয়?
(৪)
আর রুমির মা! তিনিও তো তাইলে সেরা বোকা। বোকা মহিলা বলে কিনা, যা, দেশের জন্যে তোকে কোরবানি দিয়ে দিলাম। বোকা নয়! বোকাই তো বলবেন আপনারা।
এই মেয়েটা, তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি, এ তো কেবল চাকরী কোরবানি করতে প্রস্তুত বলেছে- আম্মার মতো নিজের পুত্রকে তো কোরবানি করতে চায়নি! বোকা বলেন আপনারা ওকে, ঠিক আছে। সে হয় একটা বোকা মেয়ে।
সত্যি কথাটা কি জানেন? আমাদের দরকার হচ্ছে এইরকম আরও অনেক অনেক বোকা ছেলেমেয়ে। আপনি আমি ওর কথাগুলি সমর্থন নাও করতে পারি- কিন্তু ছেলেমেয়েরা চিন্তা করবে, মত প্রকাশ করবে, কখনো কখনো বিপদেও পড়বে এটা মন্দ কিছু নয়।