বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। গত দুই মাসে প্রায় দেড় শতাধিক কোম্পানি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মধ্যে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৩টি কোম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি কিছুটা অস্বাভাবিক।
গত অর্থবছরে ২৭৫টি কোম্পানি বন্ধ হয়েছিল, তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের ধারা দেখে মনে করা হচ্ছে যে এই বছর শেষ হওয়ার আগেই এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে, বিশেষত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসার পরিবেশ উন্নত না হলে আগামীতে আরও কোম্পানি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে সরকারের সহযোগিতা চান ব্যবসায়ীরা।
যেসব কোম্পানি বন্ধ হচ্ছে, তাদের পরিচালনা পর্ষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্থায়ীভাবে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকটের ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানিগুলোর তালিকায় বিভিন্ন আকারের প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে ছোট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বড় বড় গ্রুপের প্রতিষ্ঠানও অন্তর্ভুক্ত। বন্ধের প্রক্রিয়া হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ম অনুযায়ী অবসায়নের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এখন পর্যন্ত ১৬০টিরও বেশি কোম্পানি তাদের বন্ধের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরে নিবন্ধিত এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পণ্য সরবরাহকারী ও সেবাদানকারী দুই ধরনের কোম্পানিই রয়েছে।
বর্তমান সংকটে এমন কিছু কোম্পানিও বন্ধের তালিকায় রয়েছে, যারা নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে নিবন্ধন করেছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, যা দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত, তা শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সংকটের মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যবসায়ীদের জন্য চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে।
এছাড়া, সরকার পরিবর্তনের পর গত দুই মাসে ১৬১টি কোম্পানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা অর্থনৈতিক অস্থিরতার ইঙ্গিত দেয়।
কিছু কোম্পানি আরজেএসসিতে বন্ধের আবেদন ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার মাধ্যমে কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। এভাবে কোম্পানি বন্ধ হওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ভাল লক্ষণ নয়।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও মীর গ্রুপের চেয়ারম্যান মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘আগে থেকেই দেশের অর্থনীতি সংকটে থাকায় বেশ কিছু কম্পানি সমস্যায় আছে। কিছু কম্পানি সংকট কাটাতে পারলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অতি দ্রুত এসব সমস্যা কাটিয়ে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি হবে, এটা আশা করা যায়।’
দেশের এক শীর্ষস্থানীয় করপোরেট গ্রুপ তাদের ৩০টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই কম্পানিগুলো বন্ধের প্রক্রিয়া তদারকি করার জন্য অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এবং অবসায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আইনজীবী জি কে রাজবংশী।
পোলট্রি ও ফিশ ফিড, ভেজিটেবল অয়েল মিল, কোনাপাড়া অয়েল মিলস, হাসান ভেজিটেবল অয়েল মিলস, রূপসী সুগার মিলস, শম্পা সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, সাগুরনাল হ্যাচারি অ্যান্ড ফিশারিজ, এফ রহমান শিপিং লাইনস, প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল, এফ রহমান অয়েল মিলস, আজগর অয়েল মিলস, দি এশিয়া প্যাসিফিক রিফাইনার্স, সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ (ইউনিট-২), হাসান ডাল মিলস, ফাইবার্স, হাসান পেট ইন্ডাস্ট্রিজ, হামিদা প্লাস্টিক কনটেইনার্স, হাসান প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ, বিস্কুট, কনডেন্সড মিল্ক, হামিদা অ্যাগ্রো ফুড, ফারজানা অয়েল রিফাইনারিজ, ব্র্যান অয়েল, কোকোনাট অয়েল মিল, রহমান কোকোনাট অয়েল মিলস, হেয়ার অয়েল, শম্পা পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি, হোসেন্দি পেপার মিলস, টেস্টি বাইট ও দ্বীপা ফুড প্রডাক্টস।
অন্য একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাদের পাঁচটি কোম্পানি বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছে এবং গত সেপ্টেম্বর মাসে তারা একটি ইজিএম (এক্সট্রা অর্ডিনারি জেনারেল মিটিং) করেছে। ওই সভায় প্রতিষ্ঠানটির সিকিউরিটি সার্ভিস, ফার্নিচার, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং অ্যাগ্রো খাতের জন্য অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই তথ্যটি একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কোম্পানির চেয়ারম্যান প্রকাশ করেছেন।
সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত মাদারীপুরের আসমত আলী খান সেন্ট্রাল হসপিটাল লিমিটেড বন্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি, স্বাস্থ্য খাতের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ল্যাব কোয়েস্টও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার জন্য নাসির উদ্দিনকে অবসায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ইস্পাত খাতের একটি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি এবং এই গ্রুপের রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ধের জন্য সিফিক বসাক অ্যান্ড কোংকে অবসায়ক নিয়োগ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে ডায়মন্ড গোল্ড ওয়ার্ল্ড ও ডায়মন্ড গোল্ড ম্যানুফ্যাকচারিং রয়েছে। এগুলো বন্ধের জন্য গত আগস্ট মাসে রহমান সৈয়দ জিল্লুর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট প্রতিষ্ঠানকে অবসায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
পেপার কাপ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইনটেক গ্রিনপ্যাক বন্ধ করতে অবসায়ক নিয়োগ করেছে। একই সময়ে অবসায়ক নিয়োগ দিয়েছে আরবান ফিট প্রপার্টিজ, এস্কয়ার হোল্ডিং, ক্রিস্টাল আই, ভিসা ইনকরপোরেট, থ্রি এস ডিজাইন, উত্তর বাংলা ব্রোকারেজ, বুশরা অর্গানিক অ্যাগ্রো ফার্ম, হিট কনজিউমার, দ্য গোল্ডেন ব্রিকস প্রপার্টিজ, ফুডট্রি ইন্টারন্যাশনাল, ফালাক অ্যাগ্রো ফুড, এএএ ডিস্ট্রিবিউশন, আমাদের ভাবনা, টেক্স ডোর ইন্টারন্যাশনাল, নর্থ ল্যান্ড, স্যাটলো ইন্ডাস্ট্রিজ বিডি, সিটি টেকনো ভেঞ্চার অ্যান্ড লজিস্টিক ও ইউবিএস। আগস্টে কম্পানি বন্ধে দ্বিতীয় ইজিএম করেছে রিলায়েবল কেয়ার সলিউশন, রাডমেডিক্স, স্টিস সলিউশন, ভি পার্টনার বাংলাদেশ, স্কানডেক্স পাওয়ার, তাজ পোলট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড ও অ্যাভালন সফটওয়্যার।
কিছু বিদেশি কোম্পানি স্বেচ্ছায় বন্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে, দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক কোম্পানি ব্রাইড মেডিক্যাল অ্যান্ড এডুকেশন সার্ভিস লিমিটেড গত ১১ আগস্ট অনুষ্ঠিত ইজিএমে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা স্বেচ্ছায় এটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ভারতভিত্তিক আন্তর্জাতিক কোম্পানি শিপকার্ড মেরিন বাংলাদেশ লিমিটেডও স্বেচ্ছায় বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাইট টেক ইন্টারন্যাশনাল (এসএ) লিমিটেড তাদের দ্বিতীয় ইজিএমে বন্ধের অনুমোদন পেয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। যা দেশের অর্থনীতির উপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
previous post
next post