২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয় এবং ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) প্রতিষ্ঠা করে। এই ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত হয়। যদিও ২০১০’র আগে এই আইনে বিচার বা সাজা হয়নি কারও।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংসদ অধিবেশনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে একটি মৌখিক প্রস্তাব পাশ হয়। এরপরে, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এ বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়।
এই আইনের ৩ এর ১ ধারায় বলা হয়েছে যে, ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, এবং জেনেভা কনভেনশন বিরোধী কাজসহ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে যেকোনো অপরাধের বিচারের ক্ষমতা রাখে। এই আইনে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা দল, সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী সশস্ত্র বাহিনীর বিচার সম্ভব।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৫৪টি অভিযোগ দায়ের হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং আইনগত পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অভিযোগ দায়ের করা হলে, তা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বিরোধী পক্ষের দাবি ও সমালোচনার পটভূমিতে ঘটেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই অভিযোগগুলোর ভিত্তিতে কিভাবে আইনগত প্রক্রিয়া এগোবে এবং বর্তমান আইনের আওতায় কি ২০২৪ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্ভব?
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও ফৌজদারি অপরাধ বিশেষজ্ঞ এস এম শাহজাহান বলেন, ৩৭ বছরের মধ্যে যে আইনের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম চলছে, সেই আইন এখনও কার্যকর রয়েছে এবং এই আইন প্রয়োগে ১৪ বছর পরেও কোনো বাধা নেই।
আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, তদন্তকারী সংস্থা যদি তদন্ত শেষ করে তার দোষ পান এবং সেটি আদালতে উপস্থাপন করেন তবে বিচার কাজ শুরু করা সম্ভব। এই আইনেও অপরাধীকে সাজা দেয়া যাবে।
প্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না মনে করেন, এই আইনটি শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচার করার জন্য তৈরি হয়েছে এবং এর সংশোধন বা সংস্কার প্রয়োজনীয় নয়। তার বক্তব্যের মূল পয়েন্ট হল, এই আইনটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে, এবং তিনি এই আইন অনুযায়ী সাজা দেওয়ার পক্ষে নন।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের মন্তব্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের পরবর্তী যে কোনো অপরাধ, যেমন ২০২৪ সালের অপরাধও গণ্য হবে।
আইনের তিন নম্বর ধারার ২ এর ‘ক’ উপধারা অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ড, নির্মূল, দাসত্ব, নির্বাসন, কারাবরণ, অপহরণ, বন্দিকরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং রাজনৈতিক, জাতিগত বা ধর্মীয় ভিত্তিতে নিপীড়নের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সুযোগ রয়েছে।
এটি নির্দেশ করে যে ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত এসব কার্যক্রম বিচার করা যাবে, যা আইনের আওতায় পড়ে। এর ফলে, ১৯৭১ সালের পরবর্তী সময়ের অপরাধগুলোও যদি এই সংজ্ঞার মধ্যে আসে, তাহলে সেগুলোর বিচার করা সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, এই আইন অনুযায়ী কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। বরং, আইনটি স্পষ্ট করে বলেছে যে আইনটির প্রবর্তনের পূর্বে বা পরে বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচার করা যাবে।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের মন্তব্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, সেটির সাজা নির্ধারণ করা হয়নি আইন অনুযায়ী, তবে তাদের বিচারের এখতিয়ার রয়েছে। ফলে এটির সংস্কার চান চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, সকল ধারাকে সমন্বয় করে এবং যথোপযুক্ত করে আইনটি সংশোধন করা উচিত যাতে কোন ধরণের প্রশ্ন উঠতে না পারে এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়।
রাষ্ট্রের কৌশলীর বক্তব্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার দাবি অপ্রাসঙ্গিক। তিনি উল্লেখ করেছেন যে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনই যথেষ্ট এবং এই আইনে তার বিচার করা সম্ভব।
