সেতু বিভাগের বিরুদ্ধে এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, যেখানে বলা হচ্ছে, ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে সফটওয়্যার কেনার পরিবর্তে সেতু বিভাগ ৩৮ কোটি টাকার বেশি খরচ করে সফটওয়্যার ভাড়া নিয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, এই অতিরিক্ত খরচের মাধ্যমে অর্থ লোপাটের সঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস (সিএনএস) যুক্ত।
এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে যে, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ইচ্ছায় সিএনএস প্রতিষ্ঠানটি বিনা দরপত্রে এই কাজ পেয়েছে। বিশেষ করে, যমুনা সেতুর টোল আদায়ের সফটওয়্যার ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে এই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
যমুনা সেতু উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার একটি প্রধান গেটওয়ে হিসেবে কাজ করছে। ১৯৯৮ সালে উদ্বোধনের পর থেকে এই সেতুর ওপর গাড়ির চাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে, প্রতিদিন গড়ে ১৮ থেকে ১৯ হাজার গাড়ি সেতুটি পারাপার করে।
সেতুর টোল আদায়ও উল্লেখযোগ্য, যেখানে প্রতিদিন গড় টোল আদায় হয় ১ কোটি ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার মধ্যে। বিশেষ সময়গুলোতে, যেমন ঈদ উৎসবের সময়, এই টোল আদায় তিন কোটিরও বেশি হয়ে যায়।
যমুনা সেতুর টোল আদায়ের কার্যক্রম শুরুতে ঠিকাদারদের মাধ্যমে সুচারুরূপে পরিচালিত হলেও ২০১৬ সাল থেকে এতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। মামলার কারণে কোনো ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, যা টোল আদায়ের প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়।
এই পরিস্থিতিতে, সেতু বিভাগ শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা নিজস্ব জনবল দিয়ে টোল আদায় পরিচালনা করবে।
সিএনএস টোল আদায়ের কাজটি নিজেদের হাতে না পাওয়ার বিষয়টি উপলব্ধি করার পর তারা টোল আদায়ের সফটওয়্যারটি সেতু বিভাগকে প্রদান করে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে সিএনএসের সঙ্গে সরকারের ১০ মাসের একটি চুক্তি হয়। তবে, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ইচ্ছার কারণে এই ১০ মাসের চুক্তি দফায় দফায় বাড়ানো হয়, যা চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত চলে।
সিএনএসের সঙ্গে টোল আদায়ের সফটওয়্যার ভাড়াবাবদ ৮৯ মাসে সেতু বিভাগের কাছ থেকে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা নেওয়ার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই পরিমাণ অর্থ বিপুল একটি খরচ, যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য উদ্বেগজনক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সফটওয়্যারটি এক মাসের ভাড়ার তুলনায় অনেক কম খরচে কেনা সম্ভব ছিল।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ফাহিম মাসরুর বলেন, টোল আদায়ের সফটওয়্যারটি আসলে একটি ছোট ধরনের সফটওয়্যার, যা বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৫ জনের একটি কোম্পানি সহজেই তৈরি করতে পারে। তার মতে, এই ধরনের সফটওয়্যার তৈরি করতে এত টাকা খরচ করার প্রয়োজন নেই।
যমুনা সেতুর সাবেক ঠিকাদার মোবারক হোসেন বলেন, টোলের সফটওয়্যারটি তাদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল এবং তারা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। এই সফটওয়্যার তৈরির জন্য ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার বেশি প্রয়োজন হয় না।
সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস দাবি বলেন, টোল আদায়ের সফটওয়্যারটি কেনার সময় ১২০ কোটি টাকা মূল্য চাওয়া হয়েছিল। এই কারণে তারা সফটওয়্যারটি ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিএনএস কোম্পানির লাইসেন্স কানাডা প্রবাসী মুনীর উজ্জমান চৌধুরীর নামে হলেও সেতু ভবনের সবাই জানতেন যে এটি সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের প্রতিষ্ঠান। ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আনিসুল হকের ছোট ভাই আরিফুল হক এই কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন। আরিফুল হকের মৃত্যুর পর আনিসুল হক নিজেই কোম্পানিটি পরিচালনা করতেন।
সেতু বিভাগের সঙ্গে সিএনএসের চুক্তিতে পরিচালক ইকরাম ইকবাল স্বাক্ষর করেছেন। চুক্তির ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মিরপুর ডিওএইচএস। তবে, সাংবাদিকদের সেখানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া, জানা গেছে যে, সিএনএসের মূল অফিস রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মূল ভবনে ঢোকায় বাধা থাকলেও সিএনএসের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী পরিচালক জিয়াউল আহসান সরোয়ার এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, “এটি আসলে সাধারণ কোনো সফটওয়্যার নয়। দেশের বাইরে যে সফটওয়্যারগুলো মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়, এগুলো সে ধরনের সফটওয়্যার।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সফটওয়্যার ভাড়ার নামে বিপুল সরকারি অর্থ হাতিয়ে নেওয়াকে দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের একজন মন্ত্রী সরকারের সঙ্গে কোনো ব্যবসা করতে পারেন না। এটি আসলে শুরুতেই একটা অবৈধ বিষয়। তিনি যদি কোনোভাবে নামে বা বেনামে এই প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে থাকেন, সেটি তিনি করতে পারেন না।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, সফটওয়্যারের ভাড়া নির্ধারণে সেতু বিভাগের গঠিত সাত সদস্যের কমিটিও দুর্নীতির দায় এড়াতে পারে না।

previous post