আলি শরিয়তি, লেখক
(প্রথম পর্ব)
৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের মিডিয়াপাড়ায় তুঘলকি কাণ্ড চলছে। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, দখল, চাঁদাবাজি, প্রমোশন, জিরো থেকে হিরো, উড়ে এসে জুড়ে বসার পাশাপাশি চাকরিচ্যুতি ও মামলা, সবই চলছে হাত ধরাধরি করে।
পাকিস্তান আমলে বামপন্থীদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে পার্টির নির্দেশে নির্দিষ্ট কর্মীদের সাংবাদিকতায় যুক্ত করা হতো। জহুর হোসেন চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, আবদুল গাফফার চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ, এবিএম মূসা, নির্মল সেন, বজলুর রহমান, আনোয়ার জাহিদ, এনায়েতুল্লাহ খান, এরকম অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশেও মতিউর রহমান, আবুল হাসনাত, মাহফুজ আনাম, সৈয়দ ইরফানুল বারী, মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু প্রমুখ। হাল আমলে হাসান মামুন, রহমান মুস্তাফিজ, নজরুল কবীর, ফারুক ওয়াসিফ, মাহবুব মোর্শেদ, কল্লোল মোস্তফাদের কথাও উল্লেখ করা যায়।
যারা মূলত রাজনীতি করতেই সাংবাদিকতা করেন। এছাড়া একটা বিরাট বড় অংশ আছে, যাদের অন্যকিছু করার সুযোগ নেই, তারা হলো আটকেপড়া সাংবাদিক। সুবিধাবাদী এই অংশটিই সাংবাদিকতা পেশাকে কলঙ্কিত করে। এদের নিয়ে আজকে কিছু লিখবো না। একটা ছোট সংখ্যা আছেন, যারা পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছেন। আধুনিক রাষ্ট্রে এদেরকেই সংজ্ঞানুযায়ী সাংবাদিক বলা যায়। এরা সাংবাদিকতার প্রয়োজনে রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে বোঝাপড়া করেন। সঙ্গত কারণেই এদের কারও নামোল্লেখ করছি না।
এটা হলো সরল ও পুরান রীতির কথা। বর্তমানে পরিস্থিতি বদলে গেছে। এটারও শুরু প্রায় অর্ধ শতাব্দি পূর্বে। জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীরা সাংবাদিকতায় যোগ দেয়। তারা সাংবাদিকতা নয়, রাজনীতি করতে। যে কারণে কাদের মোল্লাও প্রেস ক্লাবের সদস্য হতে পেরেছিলেন। ডান ও বামের মধ্যে নীতিগত ফারাক থাকলেও কার্যক্রমে এরকম অনেক মিল দেখা যায়। এই প্রবণতা গত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বিভিন্ন মিডিয়া হাউজের সুশীল ঘরানার সাংবাদিক বা ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর অথবা অন্যান্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরতদের অধিকাংশই জামায়াতি। জুলাই-আগস্ট আন্দোলন এবং পরবর্তী কার্যক্রমে এটা মিডিয়াপাড়ায় ক্লিয়ার হয়ে গেছে।
গত আওয়ামী লীগের সরকার যতগুলো টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দিয়েছে, প্রায় সবগুলোই পেয়েছিল সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও দলের নেতা-অনুসারীরা। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অধিকাংশই লাইসেন্সধারীরা বিক্রি করে দিয়েছেন, অথবা শেয়ার বিক্রি করেছেন বিএনপি-জামায়াতের ব্যবসায়ীদের কাছে। লাইসেন্সধারী অল্প শেয়ার নিজের হাতে রেখে এবং ক্ষমতার জোরে এতদিন কর্তৃত্ব করলেও ৫ আগস্টের পরে সবাই কর্তৃত্বহীন হয়ে গেছেন। ইনভেস্টর যথাসময়ে হাজির হয়ে কর্তৃত্ব হাতে তুলে নিয়েছেন। এই পরিস্থিতি থেকে আওয়ামী লীগের জন্য শিক্ষণীয় অনেক বার্তা আছে। শিক্ষা নিবে?
শুধু বেসরকারী টিভি চ্যানেলই নয়, সরকারী বাংলাদেশ টেলিভিশনেও এসেছে পরিবর্তন। মো. মাহবুবুল আলম নামে একজন সাংবাদিক ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকে মহাপরিচালক পদে বসানো হয়েছে। তিনি দিগন্ত মিডিয়ার ডিএমডি ছিলেন। এভাবেই সবকিছু জামায়াতিকরণ হচ্ছে কিনা তা পণ্ডিতগণ ভেবে দেখুক!
মিডিয়াপাড়ায় চলছে ভাঙ্গাগড়ার খেলা। আজ কয়েকটি চ্যানেল নিয়ে আলোচনা করবো।
সৈয়দ শাফায়েতুল ইসলাম, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। তিনি চ্যানেল ৯ নামে একটি চ্যানেলের অনুমোদন নিয়ে বিক্রি করে দেন বিএনপির একজন ব্যবসায়ীর কাছে।
রংধনু টিভির লাইসেন্স নেন আওয়ামী লীগ নেতা খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি একেবারেই বিক্রি করে দেন মাফিয়া ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের কাছে, যা এখন নেক্সাস টিভি নামে সম্প্রাচারিত হয়।
টিভি টুডে নামে একটি চ্যানেলের অনুমোদন নেন সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল। তিনি গাজীপুরের আলোচিত জাহাঙ্গীর আলমের কাছে প্রথমে শেয়ার বিক্রি করেন, কিন্তু সেটা স্থায়ী রুপ পায়নি। পরে রংধনু গ্রুপের রফিকুল ইসলাম ওরফে আণ্ডা রফিকসহ একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়ে অংশীদার বানান। কিন্তু আজ অব্দি টিভি টুডে আলোর মুখ দেখেনি। রফিকুল ইসলাম সাংবাদিক নাদিরা কিরণকে এক্সিকিউটিভ এডিটর বানিয়ে ফেলেছিল বুলবুলকে না জানিয়ে। এই বিরোধে রফিক-বুলবুল খাতির ভেঙ্গে যায়।
সাংবাদিক কথনে ফেরা যাক। গত ৫ আগস্টের পরে দেখা যায় এরাই বেশি আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, হত্যামামলার আসামী হচ্ছেন। সাথে কিছু সুবিধাবাদীও যুক্ত হয়ে গেছেন, অতি সুবিধা ভোগ করা ও প্রেসক্লাব-ডিআরইউ নির্বাচনের বদৌলতে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চলেছে দেদারছে। সময় টিভি, একাত্তর টিভি, এটিএন বাংলা, এটিএন নিউজ, গান বাংলা, এশিয়ান টিভি, বিজয় টিভি ও মাই টিভি অফিসে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। শুধু টিভি স্টেশনেই হামলা নয়, গ্যারেজে ও সামনের রাস্তায় রাখা অগণিত গাড়িও জ্বালিয়ে ছাই করা হয়। বিটিভির কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশ-বিদেশের সবাই জানেন, বিটিভি ধ্বংসের চিত্র।
দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সময় টিভি ও মাই টিভি আবার সম্প্রচারে গিয়েছিল। কারণ বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য ও ধানমন্ডি থানার সভাপতি শেখ রবিউল আলমকে সময় টিভি দিয়েছিল নগদ ২ কোটি টাকা, মাই টিভি দিয়েছিল নগদ ১কোটি ২০লাখ টাকা। সাথে মাসোহারা হিসেবে ১০লাখ করে দেবার অলিখিত চুক্তি। আর রবিউলের মাধ্যমে স্থানীয় খুচরা নেতাদেরকে দৈনিক ৫০ হাজার করে দিয়ে দুটি টিভি চালু করেছিল। শেখ রবিউল সম্প্রতি দীপ্ত টিভির কর্মকর্তা তানজিল জাহান ইসলাম নামে একজনকে হত্যার সাথে জড়িত হওয়ায় বিএনপি থেকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেয়া হয়েছে। রবিউলের মালাকানাধীন ডেভেলপার কোম্পানির প্লেজেন প্রোপার্টিস লিমিটেডের সাথে ঝামেলার কারণেই খুনের ঘটনা ঘটে। গত প্রায় ১৮ বছর বিএনপি ক্ষমতায় নেই, আওয়ামী লীগ নাকি সবকিছুই দখল করে রেখেছিল, তাহলে রবিউল কিভাবে ডেভেলাপার কোম্পানী খোলে ব্যবসা করলেন? আলোচিত সাংবাদিক নাদিরা কিরণ এই প্লেজেন প্রোপার্টিস লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। কে যে কোথায় আটকে গিয়ে লটকে ও লেপ্টে আছে, স্রষ্টার দুনিয়ায় তা বলা মুশকিল।
সময়ের অসময়-কথন হলো ৫ আগস্টের পরে যাদের অস্বাভাবিক পদোন্নতি হয়েছে তাঁদের মধ্যে সময় টিভিতেই আছেন তিনজন, ত্বোহা খান তামিম, আতিকুর রহমান তমাল ও কামাল শাহরিয়ার। তামিম রিপোর্টার থেকে অ্যাসাইনমেন্ট ডেস্ক কো-অর্ডিনেটর, তমাল অ্যাসোসিয়েট স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট থেকে অ্যাসাইনমেন্ট ডেস্ক কো-অর্ডিনেটর এবং কামাল ন্যাশনাল ডেস্ক ইনচার্জ থেকে হেড অব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হয়েছেন।
অপরদিকে একই চ্যানেলের অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর খান মুহাম্মদ রুমেল, চিফ আউটপুট এডিটর লোপা আহমেদ ও বুলবুল রেজাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। একদিকে পদোন্নতি অপরদিকে চাকরিচ্যুতি!
সময় টিভির লাইসেন্স নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল ইসলামের ভাগ্নে আহমেদ জোবায়েরের নামে। এটারও অধিকাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেন সিটি গ্রুপের কাছে। সিটি গ্রুপ এন্টি-আওয়ামী লীগ হিসেবে সুপরিচিত। সিটি গ্রুপ নিজেরাও এখন টিভি নামে একটি চ্যানেলের লাইসেন্স নিয়ে পরিচালনা করছে। নিয়তির নির্মম পরিহাস, আহমেদ জোবায়েরকেও এমডি পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে সিটি গ্রুপ ও পরিচালনা পর্ষদ।
চ্যানেল ২৪ ও দৈনিক সমকাল, এই মিডিয়া দুটি বিগত আন্দোলনের পক্ষে বিরাট ভূমিকা রেখেছে, তাই ভাঙচুর বা দখলের মুখোমুখি হয়নি। কিন্তু এগুলোর মালিক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সাবেক আওয়ামী লীগার একে আজাদের কাছে ১কোটি টাকা দাবি করেছিল ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি ও তেজগাঁও থানার বিএনপি নেতারা। একে আজাদ টাকা দেননি, ফলে খুনের মামলার আসামী হয়েছেন। দৈনিক সমকালের লাইসেন্স পেয়েছিলেন গত জামায়াত-বিএনপি আমলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সুপারিশে, আর চ্যানেল ২৪ এর অনুমোদন পেয়েছেন মালিক নিজেই আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে।
সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন ইনডিপেন্ডেন্ট টিভিতে একটি ফুলের আঁচড়ও লাগেনি। ১/১১ এর কুশীলব সিইও শামসুর রহমান মোমেন নিজেই বিএনপি ঘরানার, যদিও এই বর্ম তেমন কাজে লাগেনি। শামসুর রহমান মোমেন ডেইলি স্টারে থাকতেই ইমপ্যাক্ট কমিউনিকেশন্স নামে পিআর কোম্পানীর মালিক হয়ে একবার দরবেশের পক্ষে ও ডেইলি স্টারের বিপক্ষে প্রেস কনফারেন্স করে আলোচিত ও সালমানের কাছের লোক বনে যান। ৫ আগস্ট চ্যানেলটি মূলত বিএনপি নেতা সাইফুল আলম নীরবের মধ্যস্ততায় রক্ষা পাওয়ার খবর মিডিয়াপাড়ার আলোচিত ঘটনা। এসবের ফলাফল সম্প্রতি ভালো মানুষের ভেক ধরা বিএনপি ঢাকা মহানগরী উত্তরের কমিটি বাতিল করেছে। ৫ আগস্টের পরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে যাদের অস্বাভাবিক পদোন্নতি হয়েছে তাঁদের মধ্যে একজন আকমল হোসেন। বিএনপির এই সাংবাদিক চ্যানেলটির সিনিয়র বার্তা সম্পাদক থেকে হেড অব নিউজ হয়েছেন। অপরদিকে প্রধান বার্তা সম্পাদক আশিস সৈকত ও সিনিয়র রিপোর্টার অনিমেশ কর-কে অফিসে যেতে বারণ করেছেন সিইও, যদিও বেতন চালু রেখেছেন।
যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান যমুনা টিভি ও দৈনিক যুগান্তর আন্দোলনের পক্ষে জোড়ালো ভূমিকা রেখেছে। যে কয়জন সাংবাদিক আন্দোলনের কৌশল ও গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে যমুনা টিভির সিইও ফাহিম আহমেদ অন্যতম। ফাহিম আহমেদ চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালে ছাত্রশিবিরের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
৫ আগস্ট একাত্তর টিভিতে আগুন লাগিয়ে দিলেও পরদিনই চালু করতে সক্ষম হয়। এর পিছনেও রয়েছে রহস্য। চ্যানেলটির বিএনপি বিটের রিপোর্টার শফিক আহমেদ একদিনেই বিশেষ প্রতিনিধি থেকে হেড অব নিউজ পদে বসেন এবং ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে এমডি ও সিইও মোজাম্মেল বাবু গ্রেফতারের পরে শফিক আহমেদ হেড অব অপারেশন্স পদে সমাসীন হয়ে পুরো চ্যানেলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হয়েছেন। একাত্তর টিভির লাইসেন্স মোজাম্মেল বাবুর নামে হলেও অধিকাংশ শেয়ার বিক্রি করেছেন মেঘনা গ্রুপের মালিক মোস্তফা কামালের কাছে। মোস্তফা কামাল বিএনপির ডোনার হিসেবে পরিচিত।
ডিবিসি নিউজ চ্যানেলে কয়েক দফা ভাঙচুরের চেষ্টা চললেও এর ইনভেস্টর আহসান সাহেব বিএনপির ব্যবসায়ী হওয়ায় এবং আবদুল আউয়াল মিন্টুর হস্তক্ষেপে রক্ষা পায়। কিন্তু ভেতরে ঘটে তুঘলকি কারবার। চেয়ারম্যান ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও সিইও মঞ্জুরুল ইসলাম, দুজনে মিলে প্রথমে চাকরিচ্যুত করেন সম্পাদক প্রণব সাহাকে। অভিযোগ তোলেন নারীঘটিত কেলেংকারির আর দায় চাপিয়ে দেন অপর সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টুর ওপরে।
এদিকে প্রণবকে চাকরিচ্যুত করলেও বেতন ও গাড়ির সুবিধা বহাল রেখেছে ডিবিসি কর্তৃপক্ষ। এরপরে পিন্টু ও অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর মাসুদ ইবনে আইয়ুব কার্জনকে চাকরিচ্যুত করেন এবং দায় চাপিয়ে দেন বিএনপির ওপরে। মঞ্জুরুল ইসলাম আমেরিকায় চলে গেলেও ইকবাল সোবহান চৌধুরী প্রেস ক্লাবে জামায়াতের আমিরের সাথে চা চক্রে মিলিত হয়ে জিহাদে শরিক হয়েছেন। এখানেও একজনের কপাল খুলেছে, বিএনপি বিটের সিনিয়র রিপোর্টার জাকারিয়া রাতারাতি পদোন্নতি পেয়ে চিফ রিপোর্টার হয়েছেন। ডিবিসি নিউজ চ্যানেলের লাইসেন্স পান সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও মঞ্জুরুল ইসলাম। তারাও বিএনপির ব্যবসায়ী আহসান সাহেবের কাছে শেয়ার বিক্রি করে দেন।
এককালের আলোচিত টিভি চ্যানেল একুশে টিভি। যার সাথে দেশ-বিদেশের অনেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন। গত জামায়াত-বিএনপি জোট আমলে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আবদুস সালাম সাহেব ছিলেন চেয়ারম্যান ও এমডি। ঘটনাচক্রে ২০১৫ সালে চ্যানেলটি কিনে নেয় এস আলম গ্রুপ। তারা প্রায় ৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এবং মনজুরুল আহসান বুলবুলকে প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব দেয় নতুন কাঠামো তৈরি করার জন্য। বুলবুল সহকর্মী হিসেবে নিয়ে আসেন সাংবাদিক ফারহানা নিশোকে। দুজনে মিলে এস আলমের বিনিয়োগ লাপাত্তা করেন। যার ফলে ১৭ কোটি টাকার হিসাব দিতে না পারায় তারা পদচ্যুত হন এবং চ্যানেলটির বারোটা বাজিয়ে দেন।
এরপর থেকে খুঁড়িয়ে চলা একুশে টিভি ৫ আগস্ট বিকেলেই বিএনপির সহায়তায় দখল করেন সাবেক মালিক আবদুস সালাম। মজার ব্যাপার হলো পরিচালক রবিউল হাসান অভি ও হেড অব নিউজ রাশেদ চৌধুরীও আবদুস সালামকে স্বাগত জানিয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য রাশেদ চৌধুরীর, তাঁকে অল্পদিনের মধ্যেই গদিছাড়া করা হয়। এছাড়াও সিনিয়র রিপোর্টার ফারজানা শোভা, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইসরাফিল শাহিনসহ আরও কয়েকজনকে পত্রপাঠ বিদায় দেন এবং পুরানো লোকদের ফিরিয়ে আনতে শুরু করেন। আলোচিত সাংবাদিক ফারহানা নিশোর বিষয়ে মানুষের আগ্রহ আছে। তাই জানিয়ে রাখি, তিনি গুলশানের যে ফ্ল্যাটে বসবাস করেন সেটি তার নিজের নামে হলেও টাকা পরিশোধ করেছিল আলোচিত ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরী। ডেভেলাপার কোম্পানীর ফাইল ও ব্যাংকের চেকের খোঁজ নিলেই এর সত্যতা মিলবে।
ব্যবসা ও মাস্তানীতে অপ্রতিরোধ্য বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন মিডিয়া হাউজেও দখলের ঘটনা ঘটেছে। কিছু ভাঙচুরও হয়েছে একদিন। নিউজ ২৪ এর ডিএমডি হয়েছেন বিএনপি নেতা ও সাংবাদিক কাদের গনি চৌধুরী। তিনি এককালে দৈনিক দিনকাল ও আমার দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন। এবার এক লাফেই ৫লাখ টাকা বেতনে একটি নিউজ চ্যানেলের ডিএমডি পদ দখল। এই দখলের জন্য তাঁকে বিএনপি থেকে বহিস্কারও করা হয়েছে। ৫ আগস্টের পরে দেশ টিভির সিনিয়র রিপোর্টার আজিজুর রহমান কিরণ যোগ দেন নিউজ ২৪ চ্যানেলে, চিফ নিউজ এডিটর পদে, কাদের গণি চৌধুরীর ডানহাত হিসেবে। আরেকজন শরীফুল ইসলাম খান, যমুনা টিভির সিনিয়র রিপোর্টার থেকে নিউজ ২৪ এর হেড অব নিউজ পদে যোগ দেন চৌধুরী সাহেবের বামহাত হিসেবে। অপরদিকে সিএনই রাহুল রাহা এবং সিনিয়র রিপোর্টার জয়দেব দাশকে করা হয় চাকরিচ্যুত। কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।
প্রয়াত সাবেক মেয়র আনিসুল হক নিয়েছিলেন নাগরিক টিভির লাইসেন্স। আনিসুল হক বেঁচে থাকতে চ্যানেলটির প্রধান নির্বাহী ছিলেন আবদুন নুর তুষার। পরে তুষারের সাথে আনিসুল হকের পরিবারের ঝামেলায় তুষার বিতাড়িত হন এবং চ্যানেল পরিচালনার দায়িত্ব পান দ্বীপ আজাদ। আওয়ামী পন্থী সাংবাদিক নেতা দ্বীপ আজাদ এককালে ছিলেন খুলনার মফস্বল প্রতিনিধি ছিলেন। যদিও তার ছাত্রজীবনে শিবির সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, কিন্তু সম্প্রতি তাকেও নাগরিক টিভি থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই দ্বীপ আজাদ ও আরেকজন সাংবাদিক ৬০ লাখ টাকার দামের একই ব্র্যান্ডের নতুন গাড়ি কিনে আলোচিত হন। চ্যানেলের সিনিয়র রিপোর্টার বুলবুল রেজাকেও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
এটিএন বাংলার শীর্ষ দায়িত্ব নিয়েছেন বিএনপিপন্থী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও ভুয়া বিতার্কিক হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। তাঁকে জ ই মামুনের বস বানানো হয়েছে। গত আন্দোলনে জ ই মামুনের বিরাট ভূমিকা থাক লেও ৫ আগস্টের পরে তিনিও চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, এবং তিনিই একমাত্র সাংবাদিক যিনি অল্পদিনের মধ্যেই চাকরি ফিরে পেয়েছেন। কি কারণে জানিনা, তবে জ ই মামুন দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবনে নিষিদ্ধ ছিলেন, যেমন ছিলেন মুন্নি সাহা। কিন্তু এরপরেও গত নির্বাচনে মামুন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটিতে ব্যাপক কাজ করেন। নির্বাচনের পরপরই তিনি ও দ্বীপ আজাদ দুজনে গাড়ি কিনে আলোচিত হন। দুষ্টু লোকেরা বলে, গাড়ির রহস্য উদ্ঘাটন করতে মিরপুরের ইসিবি চত্বরে ঘোরাঘুরি করতে হবে।
এটিএন নিউজের বার্তা প্রধান প্রভাষ আমিনের চাকরি নট হয়েছে সম্প্রতি। একই প্রতিষ্ঠানে হেড অব নিউজ পদে প্রমোশন পেয়েছেন শহিদুল আযম। এজন্যই বলা হয়, লুঙ্গি ও কপাল, কার কখন খোলে বলা কঠিন।
দেশ টিভির লাইসেন্স নিয়েছিলেন বিগত জোট আমলে বিএনপি নেতা আরিফ হাসান। আরিফ ছিলেন ২০০১ সালে কসবা থেকে নির্বাচিত বিএনপির এমপি ও সাবেক সচিব মুশফিকুর রহমান(সিএসপি-১৯৬৫) এর পিএস। নারী সাপ্লায়ার হিসেবে পরিচিত আরিফ হাসান প্রথমে ল্যাব এইডের মালিক ডা. একেএম শামীমকে বিনিয়োগকারী হিসেবে বেছে নেন এবং শামীমও মোটা অংক বিনিয়োগ করেন। কিন্তু শামীমের সাথে বনিবনা না হওয়ায় টাকা ফেরত না দিয়েই নতুন বিনিয়োগকারী সন্ধান করেন। এক্ষেত্রে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ঘটকালী করে সাবের হোসেন চৌধুরী ও আসাদুজ্জামান নূরকে রাজী করিয়ে বিনিয়োগ করান। এভাবেই শেয়ার কিনে সাবের হোসেন চৌধুরী ও আসাদুজ্জামান নূর কয়েক বছর মালিকানা ভোগ করে আবার আরিফের কাছেই শেয়ার বিক্রি করে অবশেষে বিদায় নেন। ৫ আগস্টের পরে বর্তমান কর্তৃপক্ষ সিনিয়র রিপোর্টার জয় কুমার যাদবকে চাকরিচ্যুত করেছেন বিনা কারণে।
টিভি চ্যানেল থেকে চাকরিচ্যুতির আরও ঘটনা আছে। দীপ্ত টিভির বিশেষ প্রতিনিধি নাজমুল হোসেনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই নাজমুল হোসেন হলেন লেখক সাংবাদিক অমিতাভ দেউড়ির লেখা বই কেলেঙ্কারি করে বিখ্যাত হওয়া চ্যানেল আই ও যমুনা টিভি হয়ে দীপ্ত টিভির নাজমুল হোসেন। এশিয়ান টিভি থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন হালিমা আক্তার লাবণ্য।
এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন। পরে দিগন্ত টিভিতে যোগ দেন রাজনীতির প্রয়োজনে। দিগন্ত বন্ধ ছিল। এবার তিনি গিয়েছিলেন বিজয় টিভি দখল করতে। কিন্তু শেষমেশ পিছু হটেন। দখলে কেউ পিছিয়ে থাকতে চাইছে না।
সম্প্রতি বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, অনেকেই প্রবাসে দীর্ঘদিন বিলাসী জীবন কাটিয়ে পরিবর্তনের হাওয়ায় ওড়ে দেশে ফিরেই বিভিন্ন মিডিয়া দখলে নেমেছেন। তিনি কাদের কথা বলেছেন? অনুমান করি শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান, শাহেদ আলম, মনির হায়দার, সালেহ আহমেদ, মুশফিক ফজল আনসারী প্রমুখের দিকেই তীর ছুঁড়েছেন।
টিভি চ্যানেলগুলো থেকে আওয়ামী লীগ বিট বাতিল করা হয়েছে। ফলে কাউকে অন্য বিটে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, নয়ত চাকরি নট করা হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চাকরিচ্যুতি চলতেই থাকবে। এটা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নাকি সরকারের সিদ্ধান্ত তা জানতে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দলীয় লোক কিংবা যাকেই লাইসেন্স দেয়া হোক, তিনি দুর্দিনে পাশে থাকবেন বা সমর্থন দিবেন, এই চর্চা বাংলাদেশে গড়ে উঠেনি। এমনকি পেশাদার কাউকে লাইসেন্স দিলেও যে নৈতিক কারণে অন্তত কৌশলী সাপোর্ট দিবে, এমন মনে করাও বোকামী। এসব জানতে হলে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস বোঝা জরুরি। সুবিধাবাদ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
পরের পর্বে থাকবে দৈনিক পত্রিকা নিয়ে নয়া স্বাধীনতার পরের গল্প…
#আলিশরিয়তি