আলি শরিয়তি, লেখক
আবারও ধেয়ে আসছে গণগ্রেফতার। শুরু হবে গণবাণিজ্য।
ডেইলি স্টারে নিউজ করেছে অক্টোবরের ১৩ দিনে ১৬৯৫ মামলায় ৩১৯৫ জন গ্রেফতার হয়েছে। এটা পুলিশের মিডিয়া শাখা থেকে প্রদত্ত তথ্য। গ্রেফতারকৃত সবাই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বৃহত্তর আওয়ামী পরিবারের সদস্য।
এর আগে ৮ অক্টোবর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় নিউজ বেরিয়েছিল, ‘অক্টোবরের প্রথম সাতদিনে দেশব্যাপী গ্রেপ্তার ৭,০১৮ জন’। এটা ছিল পুলিশ, র্যাব, যৌথবাহিনীর সম্মিলিত গ্রেফতারের তালিকা।
এখানে দুইরকম তথ্য পাওয়া গেলো। যারাই গ্রেফতার করুক, দিনশেষে সকল আসামীকে থানাতেই হস্তান্তর করা হয়। তাহলে পুলিশের মিডিয়া শাখার বরাতে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত নিউজ ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নিউজের মধ্যে কোনটি সত্য?
এসব দেখে মনে হচ্ছে, গ্রেফতারের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। আর অজ্ঞাত আসামীর তালিকায় গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে কি পরিমাণ টাকা লেনদেন হচ্ছে সেই হিসেব হয়ত কোনোদিনই জানা যাবে না। শেয়ার বাজার থেকে ৩১ হাজার কোটি টাকা উধাও, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি, সংস্কার সংস্কার খেলা, বিচার বিচার করে উচ্চ নিনাদে বিলাপ, আন্দোলনকারীদের ইনডেমনিটি প্রদানের প্রক্রিয়া, এসবের আড়ালেই চলছে গ্রেফতার বাণিজ্য, গ্রেফতার আতঙ্ক ও গণগ্রেফতার।
ইউনূস সরকারের মূল পুঁজি ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরি করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা। আর তলে তলে টেম্পু চালানো, অর্থাৎ ভারতের সাথে সম্পর্ক বাড়ানো।
আর দেশের পুলিশ বাহিনীর বর্তমান কর্তারা যেন চেয়ার পেলেই খুশি। এদিকে ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে গিয়ে হত্যা ও গণহত্যায় অংশ নেওয়া পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের বিচারের আওতায় আনতে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।‘ এখন পর্যন্ত সারাদেশে ৩০০টি মামলায় অন্তত ৪৫০ জন পুলিশকে নামোল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামীর তালিকায় অনেক ক্ষেত্রে পুরো থানার সবাইকে আসামী করার ঘটনাও আছে। আসামির তালিকায় আছেন ৪জন সাবেক আইজিপি ও ২০ জন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি। ইতোমধ্যে ২জন সাবেক আইজিপিসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৭ জন কর্মকর্তা।
এদিকে ৪৩জন পুলিশ হত্যার তথ্য প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা কতজন তা এক বিরাট রহস্য। আহতের সংখ্যাও জানানো হয়নি আজ পর্যন্ত। পুলিশ নিয়ে যেনো সবাই খেলছে, নাটক করছে।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের হাতে সারাদেশের ৪৫০টিরও বেশি থানা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ও লুটের ঘটনা ঘটেছে। অস্ত্র লুটের ঘটনাও আছে। কিন্তু এসব নিয়ে বর্তমান সরকার ও পুলিশ কর্তাদের কোন বক্তব্য নেই। সম্প্রতি আইজিপি মিহিসুরে বলেছিলেন, পুলিশ হত্যারও বিচার হবে। নোয়াখালীতে দুজন গ্রেফতারও হয়েছে।
এরপরেই সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়া ও নাহিদ ইসলামসহ ছাত্র সমন্বয়কেরা বলতে শুরু করেছেন, ‘আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই।‘ অর্থাৎ, শুধু পুলিশ ও আওয়ামী লীগকেই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
পুলিশ বা আওয়ামী লীগারকে মেরে ফেললেও বিচার করা হবে না, বিচার করা যাবে না। পঁচাত্তরের আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পরে যেমন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল মোশতাক এবং সামরিক শাসক জিয়া সেটাকে সংসদে উত্থাপন করে সংবিধানের অংশে পরিণত করেছিল, এখনও সেরকম পন্থা গ্রহণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দ্রুতই নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা হবে, যাতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়। কী চমৎকার দেখা গেলো!
অথচ তারা ভুলে গেছেন, তাঁদের গুরু এবং বুদ্ধিজীবী ও এনার্কিস্ট ফরহাদ মজহারের বয়ান। তিনি বলেছিলেন, ‘বোমা হামলাকারীরা সন্ত্রাসী হলে মুক্তিযোদ্ধারাও সন্ত্রাসী।‘ ফরহাদ মজহারের কথার মর্মার্থ পাঠক বুঝে নিন।
এদিকে পুলিশের বর্তমান কর্তারা ব্যস্ত আছেন গণগ্রেফতার করে গণবাণিজ্যের সুবিধা ভোগ নিয়ে। সম্প্রতি আইজিপি একটি অনলাইন সভায় এসপিদের নির্দেশ দিয়েছেন তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, আওয়ামী লীগের গন্ধ আছে, এমন সবাইকে গ্রেফতার করতে। পূজার আগে একদফা হয়েছে, কিন্তু এতে তিনি খুশি নন। পূজার পরেই যেনো সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয় তার কড়া সেই নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশও সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে। এভাবেই এবছর কৃষক পাটের ভালো দাম পাবেন।
আন্দোলনের সময়ে থানাগুলো ভাঙচুরের সময় পাশেই সেনাবাহিনীর গাড়ি ও সেনাসদস্যরা ছিলেন। কিন্তু তারা বাধা দিলেন না কেন ? পুলিশ বিভাগকে শেখ হাসিনার সরকার প্রচুর সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন, শক্তিশালী করেছিলেন। এখন দুর্বল করে দেয়া হলো। এটা কি অয়েল প্ল্যানড? এই প্রশ্ন কিন্তু উঠবেই। পুলিশের বর্তমান কর্তারা এটা বোঝেন কিনা কে জানে! তাছাড়া শোনা যাচ্ছে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পুলিশে নিয়োগ দেয়া হবে, জিয়ার আমলেও এরকম হয়েছিল।
অবশ্য বর্তমান আইজিপির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে অ্যাডিশনাল আইজিপি মতিউর রহমান সেখ। বর্তমান আইজিপি আওয়ামী লীগের আমলের সুবিধাভোগী হিসেবে তখনই অ্যাডিশনাল আইজিপি পদে প্রমোশন পেয়েছিলেন। কিন্তু বগুড়া ও ঢাকার সাবেক এসপি মতিউর রহমান সেখ ছিলেন বঞ্চিত। এখন দুই ধাপ পদোন্নতি পেয়ে অ্যাডিশনাল আইজিপি হয়েছেন। তিনিই এখন আইজিপি হবার দৌড়ে এগিয়ে আছেন। এজন্য আওয়ামী লীগ নিধন করে এবং থানা ধংস ও পুলিশ হত্যার বিচারের দাবি না করে বর্তমান আইজিপি ইউনূস সরকারের প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ ও টেকসই সুহৃদ হতে মরিয়া। গ্রেফতার ও হত্যা করে আওয়ামী লীগ নির্মূল ও দুর্বল করা যাবে না। এটা বুঝলে ভালো, না বুঝলে আরও বেশি ভালো।
আরেকটা কথা। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার আছে বিচার বিচার বিচার নিয়ে, ন্যায় বিচার নয়, তারা আছেন প্রহসনের বিচার নিয়ে। কিন্তু এসব বিচারের কথা আওয়ামী লীগ আগেই জানে, মাহমুদুর রহমানই জানিয়েছিলেন ৩০২৩ সালে। শফিউল আলম প্রধানের মৃত্যুর পরে বাংলাদেশ ভারতবিরোধিদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর মাহমুদুর রহমান বলেছিলেন, ’৭১ এ রাজাকাররা যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছিল ঠিক তেমনি অনেক মুক্তিবাহিনীও রাজাকারদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। হত্যার দায়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারের সমান অপরাধী। এই সরকার(আওয়ামী লীগ সরকার) বিশেষ ট্রাইবুনালে রাজাকারদের বিচার করছে। জামায়াত সমর্থিত দল যদি কখনো ক্ষমতায় আসে তাহলে রাজাকার হত্যার দায়ে বিশেষ ট্রাইবুনালে মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিচার করবে।‘ এটা অনুমান নয়, বরং এটা মাহমুদুর রহমানদের পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ। যা এখন ঘটছে।
সরকার ছয়টা সংস্কার কমিশন করছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান বানিয়েছেন জনাব সফর রাজ হোসেনকে। বগুড়ানিবাসী বিসিএস ৭৭ ব্যাচের কর্মকর্তা সফর রাজ হোসেন বিগত জামায়াত-বিএনপি জোট আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। তিনি স্বরাষ্ট্র সচিব থাকার সময়েই সারাদেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা হয়েছিল। জামায়াতি সচিব ওমর ফারুকের সময়ে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ জঙ্গিবাদের চাষ শুরু হয়েছিল, আর সফর রাজের সময়ে জঙ্গিবাদের ফসল ফলতে শুরু করেছিল। তিনিই হয়েছেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য হলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জনাব আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি কমিশনের সাচিবিক দায়িত্বও পালন করবেন। তাঁর সহোদর বোন জনাব ফারজানা মমতাজ সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হয়েছেন। ভাই-বোন দুজনেই বিসিএস ১৫ ব্যাচের এই কর্মকর্তা।
অনেকেরই মনে থাকার কথা গত ১৪ জুলাই ইত্তেফাকসহ একাধিক দৈনিক পত্রিকায় নিউজ বেরিয়েছিল, ‘১৫তম বিসিএস নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মেয়েকে বিয়ের শর্তে জামাইয়ের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দেন শ্বশুর। ননদও একই কায়দায় সুবিধাভোগী।‘ সেই শ্বশুর ছিলেন পিএসসি’র সদস্য। মেয়ের জামাই হলেন আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ। ননদ হলেন ফারজানা মমতাজ।
এখন দেশবাসী বুঝে নিক, পুলিশ সংস্কার কেমন হবে!