আন্দোলনের সময় প্রাণহানির ঘটনায় কেবল একপক্ষের বিচার হবে, সাফ জানিয়ে দিল ইউনূস সরকার। আন্দোলনকারীরা যে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে মামলাও করা যাবে না। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী এই আদেশ অবৈধ, বলছেন আইনজ্ঞরা।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
সংবিধান সংরক্ষণের শপথ নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানবিরোধী একের পর এক পদক্ষেপের পর এবার নিলেন এমন এক পদক্ষেপ যা মৌলিক মানবাধিকারেরও পরিপন্থি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাফ জানিয়ে দিয়েছে গত ১৫ জুলাই থেকে আন্দোলনকারীরা যত হত্যা, লুটপাট, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, সেসব ঘটনায় আদালতে কোনো মামলা করা যাবে না।
ইতিহাস রিসেট করার ঘোষণা দেওয়া মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার আসলে এক লাফে ফিরে গেলেন ১৯৭৫ সালে। ওই বছরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতায় আসা খোন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বাধীন সরকার এই ধরনের একটি আদেশ জারি করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার এক মাস দশ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করা সেই অধ্যাদেশের মূল কথা ছিল, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন খুনিদের বিরুদ্ধে কোনও আদালতে মামলা বা অভিযোগ দায়ের করা যাবে না।
ইতিহাসের কুখ্যাত সেই আদেশ ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নামে পরিচিত ছিল। পরে সেটি সংবিধানের অংশ করেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান।
কিন্তু সেই আদেশ দিয়ে খুনিদের রক্ষা করা যায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংসদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাতেই এই আদেশ বাতিল হয়ে যায়। সংবিধানের অংশ হলেও সেটি সংশোধনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগেনি এ কারণে যে, এই আদেশ ছিল সংবিধানের মূল চেতনার বিরুদ্ধে।
৩৯ বছর পর আবারও একই ধরনের একটি আদেশ জারি করল ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার, যে সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানবাধিকার ও আইনের শাসনের কথা বলছে, রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছে।
কিন্তু এই সরকারও ঠিক সেই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের মতই গত ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের বেআইনি কর্মকাণ্ডকে বিচার থেকে দূরে রাখার আইনি বৈধতা দিল।
কিন্তু আইনের শাসন ও সংবিধান অনুযায়ী এই আদেশ জারি করা যায় কিনা, সেই প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না সোজা বলেন, “কখনও যায় না। এই আদেশ অবৈধ।”
কেন অবৈধ সেটি সংবিধানেই স্পষ্ট। শাসনতন্ত্রের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
৩১ অনুচ্ছেদে আইনের আশ্রয় লাভ বিষয়ে বলা আছে, যে কোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
অর্থাৎ কোনো অপরাধ হলে তার প্রতিকারের জন্য আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংবিধান সম্মত অধিকার।
সংবিধানেই বলা আছে, কেউ চাইলেই তার সংবিধানসম্মত অধিকারকে আইন দিয়ে বাধা দিতে পারে না।
৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনও আইন যদি সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্য হয়, তাহলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে।
২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সাথে অসমঞ্জস আইন বাতিল।
২৬ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, এই ভাগের বিধানাবলির সঙ্গে সব প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হয়ে যাবে।
২৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্য কোনও আইন আইন প্রণয়ন করবে না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হলে তা মৌলিক অধিকারের কোনো বিধানের সঙ্গে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হয়ে যাবে।
কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারকে ‘স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘এই সরকারের পতনের মাধ্যমে বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে এক নবযাত্রা সূচিত হয়েছে। এ গণঅভ্যুত্থানকে সাফল্যমণ্ডিত করতে যে-সব ছাত্র-জনতা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের মাঠে থেকে এর পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ১৫ জুলাই হতে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংগঠিত জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনো মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না।
সেসব ঘটনার বিচার হবে না?
এই আইনি বৈধতা দেওয়ার সুযোগ আছে কি না, সেটি পরের আলাপ। আগে দেখে নেই এই সময়ে কী কী হয়েছে।
এই সময়ে সরকারের হিসাবে প্রায় আটশ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে গুলিতে মৃত্যু যেমন আছে, তেমনি পুড়িয়ে, কুপিয়ে, পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও কম না।
বাড়িতে ঢুকে, রাজনৈতিক কার্যালয়ে ঢুকে, সড়কে দল বেঁধে কুপিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, বাড়িতে আগুন দিতে গিয়ে নিজেরা মারা গেছে, হোটেলে আগুন দিয়ে হত্যা করা হয়েছে ২৪ জনকে।
এই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন লুট করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সদস্যদের বাড়িঘরও লুটের পর আগুন দেওয়া হয়েছে, আগুন দেওয়া হয়েছে দলটির বেশিরভাগ কার্যালয়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার।
এই সময়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভির কার্যালয়, আগুনের কারণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ ভবন এখনও ব্যবহার অনুপযোগী, সেতু ভবন লুট ও আগুন দেওয়া হয়েছে দুই দফায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আগুন দেওয়া হয়েছে দুই দফায়, মেট্রোরেলের দুটি স্টেশন ভাঙচুর করা হয়েছে।
৪ আগস্ট অসহযোগ আন্দোলন শুরুর পর দৃশ্যত বেশিরভাগ মৃত্যু আওয়ামী লীগের হয়েছে। সেদিন সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা করে ছয় জনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
একই জেলার এনায়েতপুর থানায় হামলা করে ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
একই দিন নরসিংদীতে মাধবদী পৌরসভা সংলগ্ন বড় মসজিদ এলাকায় আওয়ামী লীগের ছয় নেতাকর্মীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের চাচাতো ভাই সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটোর কিশোরগঞ্জের বাসভবনে আগুন দিয়ে তিনজনকে পুড়িয়ে মারা হয়।
সেদিন সারা দেশে সংখ্যাতে একশরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী অথবা পুলিশ সদস্য।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর হত্যা লুটের উৎসব তৈরি হয়।সেদিন ঢাকায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় লুট করা হয়, হামলা হয় জাতীয় সংসদ ভবনে।
একই দিন নাটোর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসভবন জান্নাতি প্যালেস আগুন দেওয়ার পর চার জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সুমন খানের বাসায় আগুন দেওয়ার পর ছয় জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন হোটেল জাবীর ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এক বিদেশিসহ ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
বরিশালে সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর বাসভবনে আগুন দেওয়ার পর উদ্ধার হয় তিন জনের মরদেহ।
সাদিকের বাবা গৌরনদীর সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর বাড়িতে আগুন দিয়ে হত্যা করা হয় তিন জনকে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের আলোচিত চেয়ারম্যান চলচ্চিত্র প্রযোজক সেলিম খান ও তার ছেলে অভিনেতা শান্ত খানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
সরকার পতনের কিছুক্ষণের মধ্যেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে হামলা করে সব কিছু লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ধানমন্ডি ৩/এতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়, তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়েও লুট করে আগুন দেওয়া হয়।
জেলায় জেলায় এমন বহু বাড়িতে আগুন ও লুট করা হয়েছে, বাদ যায়নি বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজার বাড়িও।
সরকার পতনের পর সবচেয়ে বেশি হত্যার শিকার হয়েছে পুলিশ। উত্তরা পশ্চিম ও যাত্রাবাড়ী থানায় কত পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়ে, তা জানা যায়নি।
চাঁদপুরে দল বেঁধে এক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও ছড়িয়েছে। সাভার, আশুলিয়া, উত্তরা, যাত্রাবাড়ীতে পুলিশকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখার ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
আন্দোলন চলার সময়ও যাত্রাবাড়ীতে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যার করে মরদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।