নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে পুলিশ সদস্য হত্যা মামলায় তিন শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হওয়ার পর ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে। এরপরেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনা বলা হয়, ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানসংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনো মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার বিষয়টি স্ট্যাটাস আকারে ফেসবুকে দিয়েছেন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। আর এরপরেই শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। এই নির্দেশনার মাধ্যমে জুলাই-আগস্টে পুলিশসহ আন্দোলনের বিরোধী অবস্থানে থাকা ব্যক্তিদের হত্যার বৈধতা দেয়া হচ্ছে কিনা, বৈধতা দেয়া হলে দায়মুক্তির আইনি ভিত্তি কী- তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এমনকি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটলেও এর পরের আরও তিনদিন কেন দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
দর্শক আমরা দেখব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাটিতে কী বলা হয়েছে। সেখানে ব্যবহৃত শব্দ ও বাক্যগুলো কী? এই নির্দেশনার আইনগত বা সাংবিধানিক ভিত্তি রয়েছে কতটা? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমস্ত ঘটনা যখন জাতিসংঘ তদন্ত করছে, তখন সরকারের এই নির্দেশনা কী বার্তা দিচ্ছে- তাও বোঝার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগকে দায়মুক্তি দেয়ার দুটি ঘটনা ঘটেছে এর আগে। প্রথমটি ১৯৭৫ সালে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যায় জড়িতদের আইনি সুরক্ষা দিতে ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খন্দকার মোশতাক সরকার। এরপর ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনটি বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে বাতিল করা হয় ইনডেমনিটি আইন। খুলে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ। আর ২০১০ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকেই অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট।
চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগকে দায়মুক্তি দেয়ার আরেকটি ঘটনা ঘটে। ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে পরের বছরের ৯ জানুয়ারি চালানো হয় অপারেশন ক্লিনহার্ট। সেনা, নৌ, তখনকার বিডিআর, পুলিশ ও আনসারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এই অপারেশনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বেশ কিছু অভিযোগ ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০০৩ সালে অপারেশন ক্লিন হার্টকে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। তবে সেটিও টেকেনি আদালতে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে হাইকোর্ট একে অবৈধ ঘোষণা করে বাতিল করে দেয়।
এছাড়াও সংসদে আইন করে আরেকটি ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেয়ার ঘটনা আছে। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার ‘কুইক রেন্টাল’ পাওয়ার প্ল্যান্টকে দায়মুক্তি দেয়। তবে সেটি সরাসরি ব্যক্তি নাগরিক ও আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় নয় বলে আজকের আলোচনায় তা নিয়ে বিস্তারিত বলছি না। আমরা নজর দিচ্ছি ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগের ক্ষেত্রে দায়মুক্তির প্রসঙ্গটিতে।
সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিক আদালতে বিচার প্রর্থনার অধিকার রাখেন। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে এই অধিকারকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বর্তমান সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দেশের সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’
আর ৩২ অনুচ্ছেদে জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার-রক্ষণ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।‘
সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৬ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য যেকোনো আইন বাতিল হয়ে যাবে।
২৬ এর (১) অনুচ্ছেদ বলছে, এই ভাগের বিধানাবলির সঙ্গে অসামঞ্জস্য সব প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হতে সেসব আইনের ততখানি বাতিল হয়ে যাবে।
আর ২৬ (২) অনুচ্ছেদ বলছে, রাষ্ট্র এই ভাগের কোনো বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য কোনো আইন প্রণয়ন করবে না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হলে তা এই ভাগের কোনো বিধানের সঙ্গে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হয়ে যাবে।
এসব অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করা হয়েছে, রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের আদালতে যাওয়ার এখতিয়ার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত।
তবে সংবিধানের তৃতীয় ভাগে আবার দায়মুক্তির একটি সুযোগও কিন্তু রাখা হয়েছে। ৪৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এই ভাগের পূর্ববর্ণিত বিধানাবলিতে যা বলা হয়েছে, তা সত্ত্বেও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি বা অন্য কোনো ব্যক্তি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজনে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যেকোনো অঞ্চলে শৃঙ্খলা-রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কোনো কাজ করে থাকলে সংসদ আইনের দ্বারা সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করতে পারবে কিংবা ওই অঞ্চলে প্রদত্ত কোনো দণ্ডাদেশ, দণ্ড বা বাজেয়াপ্তির আদেশকে কিংবা অন্য কোনো কাজকে বৈধ করে নিতে পারবে।
এই অনুচ্ছেদটি অনুযায়ী চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ হিসেবে দেখানো গেলেই কেবল অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগকে আদালতের বাইরে রাখা সম্ভব।
তবে সেটি করতে গেলে তৈরি হবে আরও ভয়াবহ জটিলতা। বর্তমান সংবিধানে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের কোনো সুযোগ নেই। অনির্বাচিত বা অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠারও কোনো বিধান নেই। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিতে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।
খেয়াল করে দেখুন, ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার কোনো সুযোগই নেই। আবার ৭ এর (১) অনুচ্ছেদ বলছে, প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে৷ তার মানে, সংবিধানই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। এবং সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠাকে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ বলার কোনো সুযোগ নেই।
উল্টো সাংবিধানিক কর্তৃত্বকে অমান্য করাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলা হয়েছে বর্তমান সংবিধানে। ৭ক এর (১) অনুচ্ছেদ বলছে- কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে বা তা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে; কিংবা- সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে বা তা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে সেটি রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবেন।
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ পরিষ্কার করছে, নির্বাচিত সরকার বিষয়ক সাংবিধানিক বিধান অগ্রাহ্য করাকে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ হিসেবে দেখানো অসম্ভব এবং এ ধরনের যে কোনো কাজ রাষ্ট্রদ্রোহের সামিল।
এবার আসি আরেকটি দিকে। কোনো বিষয়ে দায়মুক্তি দিতে হলেও সেটি অনুমোদন হতে হবে সংসদে। আর সংসদ কার্যকর না থাকলে অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতা একমাত্র রাষ্ট্রপতির। এ বিষয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে। সেখানে বলা হয়েছে সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় অথবা অধিবেশনকাল ব্যতীত কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে বলে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হলে তিনি ওই পরিস্থিতিতে যে ধরনের প্রয়োজনীয় বলে মনে করবেন, সে ধরনের অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করতে পারবেন।
তবে সেই অধ্যাদেশেও এমন কোনো কোনো বিধান করা যাবে না যা সংবিধানের অধীন সংসদের আইন-দ্বারা আইনসঙ্গতভাবে করা যায় না। অথবা সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তিত বা রহিত হয়ে যায়।
তার মানে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে নির্দেশনা দিয়েছে সেটি দেয়ার কোনো ধরনের এখতিয়ার তাদের নেই। এটি কেবল রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে হতে পারত। তবে রাষ্ট্রপতিরও এ ধরনের কোনো অধ্যাদেশ জারির এখতিয়ার নেই, কারণ বিষয়টি সংবিধানের মৌলিক বিধানের পরিপন্থি অর্থাৎ বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’।
ড. ইউনূস সরকার সাংবিধানিক না হয়েও বর্তমান সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে ক্ষমতা নিয়েছে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব নিয়ে আছে নানান আলোচনা। সে কারণেই হয়ত অধ্যাদেশ জারির চেষ্টার পথে না হেঁটে সরাসরি নির্দেশনা দিয়ে কাজ সারার পথ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে শুধু সাংবিধানিক ও আইনি প্রশ্নে নয়, মানবাধিকার প্রশ্নেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে ড. ইউনূসের সরকার।
