ভিন্ন মত দমনে আয়নাঘর নামে নির্যাতনের গোপন মঞ্চ গড়ে তুলেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এই ধারণার অন্যতম কারিগর ভাবা হয় অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে, যিনি ছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসির মহাপরিচালক। তবে জিয়াউল আহসান দাবি করেছেন, আয়নাঘরের নামে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ছড়ানো হচ্ছে।
১৬ আগস্ট গ্রেপ্তারের পর বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) আদালতে তোলা হয় জিয়াউল আহসানকে। নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা একটি গুম ও অপহরণের মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। আদালতে তোলা হলে জিয়াউল আহসানের ব্যাপারে বিচারক সাইফুর রহমান জিজ্ঞেস করেন, উনি কি অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা? তখন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, না অব্যাহতিপ্রাপ্ত নন, মূলত অবসরপ্রাপ্ত।
এরপর বিচারক মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেন, ওনার নামের পাশে অব্যাহতিপ্রাপ্ত লেখা আছে, এটা ঠিক করে দেবেন। তখন বিএনপির আইনজীবী বলেন, উনি মূলত অব্যাহতিপ্রাপ্ত। আয়নাঘরের মূল হোতা তিনি। বিগত সরকারের ঘুম খুনের কারিগর। তদন্ত কর্মকর্তার এ বক্তব্যের প্রতিবাদে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, আয়নাঘরের হোতা বললেই হলো? এসব কই পান। তখন বিচারক বলেন, এখন তো শুনানির সময় না। আপনারা চুপ করেন।
এরপর নিউ মার্কেট থানার মামলায় জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিচারক চলে যান। বিচারকের প্রস্থানের পর বিএনপির ওই আইনজীবীকে উদ্দেশ করে জিয়াউল আহসান বলেন, আয়নাঘরের মূল হোতা আমি? এসব কীভাবে বানান। আমি আয়নাঘরের মূল হোতা নই। এসব আমার নামে বানানো মিথ্যা অভিযোগ। এসময় তার চেহারায় রাগ ফুটে ওঠে। পরে পুলিশ কর্মকর্তারা জিয়াউল আহসানকে হেলমেট পরিয়ে হাজত খানায় নিয়ে যান।
আওয়ামী লীগ সরকার গোপন কারাগার তথা আয়নাঘরের কথা সবসময় অস্বীকার করলেও শেখ হাসিনার পতনের পর গুমের শিকার ব্যক্তিদের অনেকে ফিরে এসেছেন। তাদের মুখেই জানা যাচ্ছে সেই কারাগারের লোমহর্ষক বর্ণনা। এখানে বন্দিদশা থেকে ফিরে আসা যারা এক সময় চুপ ছিলেন, তারা এখন নির্মমতার বর্ণনা দিচ্ছেন, যেখানে গত দেড় দশক ধরে গুম করা ব্যক্তিদের অমানবিক অবস্থায় রাখা হতো।
কাকতালীয়ভাবে বিভিন্ন বয়সী এবং ভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের মানুষ কারাগার কক্ষের একই রকম বর্ণনা দিয়েছেন; চওড়া প্রাচীর, লোহার দরজা। বর্ণনাগুলো একত্রিত করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, গোপন কারাগারগুলো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই) পরিচালিত ছিল। ডিজিএফআই প্রধানরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাছে জবাবদিহি করেন। বিভিন্ন মহলের দাবি, আয়নাঘরের মূল পরিকল্পনাকারী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন সেনা অফিসার জিয়াউল আহসান।
জিয়াউল আহসান ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষিত কমান্ডো ও প্যারাট্রুপার ছিলেন। দীর্ঘদিন র্্যাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকার সময় তাকে ডিজিএফআইর ডিডিজি হিসেবে বদলি করা হয়। পরে তাকে সেখান থেকে এনএসআই’র পরিচালক হিসেবে সংযুক্ত করা হয় ২০১৬ সালে। ২০১৭ সালে তিনি এনটিএমসির পরিচালক হন তিনি।
২০২২ সালে তাকে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক করা হয়। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ৬ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এনটিএমসি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে গ্রেফতার করার কথা জানায় পুলিশ।

previous post
next post