বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মুবিনা আসাফ ২০০ কোটি টাকার দুর্নীতির ঘটনায় ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো বাংলাদেশ থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। আরেক বিচারপতি সগীর হোসেন লিয়ন বরগুনা-২ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানিতে দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত এক নারীকে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ নিয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নিয়োগ পেয়েছেন বিএনপির মনোনয়নে হয়ে সংসদ নির্বাচনে লড়ার চেষ্টা করা এক আইনজীবীও।
গত মঙ্গলবার ২৩ জনকে নিয়োগ দেয় আইন মন্ত্রণালয়। অন্য সময় বিচারপতিদের বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে সংবাদ মাধ্যম। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। নিয়োগ পাওয়া বিচারপতিদের অতীতের ভূমিকা কী, এ বিষয়ে কেউ কিছু লিখছে না।
তবে সামাজিক মাধ্যমে দুই জনের সম্পর্কে যে তথ্য মিলেছে, তা এই নিয়োগ নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠার জন্য যথেষ্ট।

এক বছর আগে বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো বাংলাদেশ বা বিএটি বাংলাদেশে দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত মুবিনা আসাফ নতুন এই বিচারপতিদের একজন
কোম্পানিটির করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি বা সিএসআর ফান্ডের ২০০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাদের মধ্যে মুবিনা একজন।
ঘটনাটি ঘটে ২০২৩ সালে। তবে কয়েকটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশ হয় গত মাস সেপ্টেম্বরে।
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, সিএসআরের অর্থ লোপাটের অভিযোগটি নিরীক্ষা করে বিএটির প্রধান কার্যালয়ের অডিট বিভাগ। পরে কর্মকর্তাদের তোপের মুখে কোম্পানির ঢাকা কার্যালয়ের এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স প্রধান শেখ শাবাব আহমেদ, লিগ্যাল অ্যান্ড এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান মুবিনা আসাফ, বিজনেস কমিউনিকেশন ম্যানেজার ফুয়াদ বিন সাজ্জাদ চাকরিচ্যুত হন।
এই ২০০ কোটি টাকা খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে অডিট বিভাগের কাছে কোনো জবাব দিতে পারেনি কোম্পানির এমডি শেহজাদ মুনিম। পরে এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স প্রধানের কাছে জানতে চাইলে তিনি অডিট বিভাগে বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন সবাই অবগত। এ ঘটনার পরই চাকরিচ্যুত করা হয় তাকে।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো বাংলাদেশের কোম্পানি সচিব সৈয়দ আফজাল হোসেন অর্থসংবাদ নামে একটি অনলাইন সংবাদপত্রকে বলেন, ‘কোম্পানির সিএসআরের ২০০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স প্রধানকে চাকরিচ্যুত করা হয়। জানা মতে, এতে জড়িত সবাইকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।’
চাকরিচ্যুত হওয়ার পর মুবিনা চলে যান কানাডায়। পরে তিনি কবে দেশে আসেন এবং কীভাবে ইউনূস সরকারের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়, সেই বিষয়টি আর জানা যায়নি।
তবে হাইকোর্টে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এই নারী ও তার সঙ্গীদের দুর্নীতির বিষয়ে তথ্য মিলেছে।
সিএসআর কর্মসূচির আড়ালে সারা দেশের কৃষকদের দীর্ঘদিন ধরে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে বিএটি বাংলাদেশ। শুধু কোম্পানির তালিকাভুক্ত কয়েকশ চাষির মাঝে ‘দীপ্ত’ প্রকল্পের সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ করছে।
২০১৩ সালে পাহাড়ে অন্ধকার দূর করে আলো জ্বালানো হয়েছে বলে কোটি টাকা খরচে বিজ্ঞাপন প্রচার করে বিএটি বাংলাদেশ। আইনের ফাঁক গলে এসব বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে কোম্পানির লোগো প্রচার করিয়ে নেওয়া হয়, যা বেআইনি।
মূলত অন্য কোম্পানির চাষিদের আকৃষ্ট করতে এবং পত্রিকায় নিজেদের লোগো ব্যবহার করতেই এসব সোলার বিতরণ করে বিএটি বাংলাদেশ।
বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির ৪টি গ্রামের ৫৭৬টি হত দরিদ্র পরিবারকে ‘দীপ্ত’ প্রকল্পের অধীনে সৌরবিদ্যুৎ দেওয়ার দাবি করা হলেও পরে প্রকাশ পায়, দেওয়া হয়েছে শুধু নিজস্ব চাষিদের। এদের মধ্যে অনেক অবস্থাসম্পন্ন কৃষকও ছিলেন।
যারা এই প্যানেল পেয়েছেন, সেই চাষিরা আবার জানান, ২০ ওয়াটের এ সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে তিনটি বাতি জ্বালানো সম্ভব।
এ ধরনের একটি সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনে বিএটি বাংলাদেশের খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। অথচ বিজ্ঞাপনেই খরচ করেছে কোটি টাকার ওপর।
২০১১ সাল থেকেই স্থানীয় কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে এ সৌরবিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য কথাবার্তা চালাতে থাকে বিএটি বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে পাড়ার হেডম্যান, উপজেলার বিভিন্ন সরকারি অফিসের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিষ্ঠানটি।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী যখন বিচারপতি
বিচারপতি পদে নিয়োগ পাওয়া আরেকজন হলেন সগীর হোসেন লিয়ন। তিনি বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। শুধু তাই না, ধানের শীষ প্রতীকে বরগুনা-২ আসন থেকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
হাইকোর্টে আইন পেশায় জড়িত এই আইনজীবী বিএনপির নানা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পোস্টারও ছাপিয়েছেন। তার চেম্বারে বিএনপির প্রতিষ্ঠানা সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও দলের বর্তমান চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছবি আছে।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশ কর্মসূচি সফল করতে সগীর হোসেন পোস্টার ছাপিয়েছিলেন। সেই পোস্টারের নিচে লেখা ছিল পাথরঘাটা-বামনা-বেতাগী (বরগুনা-২)।
এর মানে হল বিএনপি ভোটে গেলে সগীর এই আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গেও এই আইনজীবীর ছবি
বিএনপির সেই আন্দোলন সফল হয়নি, তারা ভোটে যায়নি, ফলে সগীরের এই ইচ্ছাও পূরণ হয়নি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর উচ্চ আদালতে যে ‘দখলের’ রীতি তৈরি হয়েছে, তাতে তিনি এক লাফে হয়ে গেলেন বিচারক।
অন্যান্য নানা বিষয়ের পাশাপাশি বিচার বিভাগে সংস্কারের কথা বলে দুর্নীতির দায়ে প্রাতিষ্ঠানিক সাজা পাওয়া আর সরাসরি রাজনীতিতে জড়িতদেরকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সরকারের কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি।
দেশের সংবাদ মাধ্যমে এদের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ না হওয়ায় এ বিষয়ে সরকারের কোনো পর্যায়ে কেউ কোনো প্রশ্নও তোলেনি।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যদিও তার সরকারকে নির্ভয়ে সমালোচনা করতে বলছেন, তবে দেশের সংবাদ মাধ্যম যে ভয়ে আছে সেটি স্পষ্ট। এমনকি মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা খবর বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটিও ছেপেছে হাতে গোনা দুই একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যম। বাকিরা এই তথ্য চেপে গেছে বা সংবাদের ভেতরে একদম চোখে পড়ে না, এভাবে উল্লেখ করেছে।