১৯৬৪ সাল। বাংলাদেশটা তখন পূর্ব পাকিস্তান। সারাদেশে চলছে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সে বছর ২৫ জানুযারি তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবত করেন। এর পরপরই মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবুর রহমানের নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়।
তিনি তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রশমনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে জেলায় জেলায় ছুটে বেড়াচ্ছেন। এরমধ্যে ২৬ জুলাই তারিখে তাঁর নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধি দল বা কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি – কঅপ গঠিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর সবেচেয়ে ছোট সন্তান শেখ রাসেল তখন বঙ্গমাতার গর্ভে।
সেই লড়াই সংগ্রামের বছরে শেখ রাসেলের পৃথিবীতে আগমনবার্তা ঘোষিত হয়। সেদিন ঢাকা শহর জুড়ে হাল্কা শীত পড়ে গেছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সেই ঐতিহাসিক বাড়ির পাশেই লেকের দুইপাড় জুড়ে প্রতি সন্ধ্যায় জমে রহস্যময় কুয়াশা। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর তারিখে এক শিশুর আগমনবার্তায় আকাশ পবিত্র হয়ে ওঠে। মায়ের কোল থেকে শীঘ্রই চলে আসে শিশুটি তার হাসু আপার কোলে। শিশুটির নাম রাখা হয় শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে আদরের ছোট সন্তান।
সেইদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন,
‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিলো ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিলো রাসেল।’
রাসেল নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। পৃথিবী বিখ্যাত বৃটিশ দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম রাখলেন রাসেল। এই নামটিকে ঘিরে নিশ্চয়ই তার মহৎ কোনো স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা ছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন বিশ্ব মানবতার উজ্জ্বল দ্যুতি, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু, বাঙালি জাতির জনক, মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা।
সেদিন শিশুপুত্র রাসেলকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কী বলে আশির্বাদ করেছিলেন তা আজ ইতিহাস। রাসেল জন্মের পর থেকে বাবাকে খুব একটা কাছে পায়নি। কী করে পাবে? তার পিতা তো জাতির পিতা। বাঙালি জাতির প্রতিটি সন্তান যে তাঁর মুখ চেয়ে বসে আছে। রাসেলের জন্মের বছর না পেরোতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। কারাগারের রোজনামচায় জাতির জনক লিখেছেন,
“৯ জুন ১৯৬৬, বৃহস্পতিবার। পাঁচটার সময় বাইরে যেয়ে একাকী বসে চিন্তা করছি, এমন সময় জমাদার এসে বললেন, চলুন আপনার ইন্টারভিউ আছে, বেগম সাহেবা ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন।…গেটের দিকে চললাম।…ছোট ছেলেটা পূর্বের মতই ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে চিৎকার করে উঠল।”
সেইদিন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যগণের সঙ্গে দেখা করার জন্য দর্শনার্থী জেলগেটের কাছে আসামাত্র রাসেল “আব্বা” বলে চিৎকার করে উঠলে তিনি রাসেলকে কোলে নেন। রাসেলের সেই “আব্বা” ডাক বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে পারেনি। বরং, জাতির পিতার উপর জুলুমের জুলুম চলে সে সময়। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সময়ে তিনি একাধিকবার সামরিক জান্তা কর্তৃক আটক হন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা গৃহীত হওয়ার পর তাঁকে সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বারবার গ্রেফতার করা হয়। মাত্র তিনমাসে তাঁকে ৮ বার গ্রেফতার করা হয়।
রাসেল তখন ২ বছরের শিশু্। মাত্র আব্বা ডাকতে শিখেছে। শৈশবের শুরু থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত, বঙ্গবন্ধুকে ওরা নানান অজুহাতে বলতে গেলে পুরো সময়টাই কারা অন্তরীণ করে রাখে।
রাসেল এইভাবেই পিতৃছোঁয়া বঞ্চিত হয়ে কখনও বঙ্গমাতার কোলে, কখনও হাসু আপার কোলে বড় হয়ে উঠতে থাকে। তার হাসু আপা হচ্ছেন আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (আজও তিনিই প্রধানমন্ত্রী সংবিধান অনুযায়ী):
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন,
‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত। ’
সবচেয়ে দুঃসময় ছিলো ১৯৭১ সালের নয়মাস। জাতির পিতাকে ওরা আটক করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। এতদিন তবু পূর্ব পাকিস্তানের কারাগারে আটক থাকলে দেখা হওয়ার সুযোগ মিলত, মুক্তিযুদ্ধের ঐ নয়মাস তার আর কোনো উপায় ছিলো না। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান জান্তা আটক রেখেছিল মিয়ানওয়ালী কারাগারে। রাসেলের বয়স তখন ৭ বছর।
ঢাকা জুড়ে মিলিটারি তান্ডবের ফলে তার শিশুমনে কতখানি ছায়া ফেলেছিল তার স্বাক্ষী মহাকাল। পিতার মৃত্যু আশংকা রাসেলকে কতটুকু পিড়ীত করেছিলো তাও আমাদের অজানা। শুধু এইটুকু সকলের জানা, এই দেশটাকে স্বাধীন করতে, আত্মপরিচয় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে, বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারের মতই শিশু রাসেলকেও যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, সেই ঋণ জাতি কোনোদিন শোধ করতে পারবে না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, অল্প কিছুদিন শেখ রাসেল জীবনকে উপভোগ করতে পারে। সদ্য শৈশব উত্তীর্ণ শেখ রাসেল তখন ভীষণ দুরন্ত। তার দুরন্তপনার সঙ্গী ছিল বাই-সাইকেল। সে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ছাড়াই সাইকেলে করে স্কুলে যেত। পাড়ার আর দশজন সাধারণ ছেলের মতো। প্রখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মুসা স্মৃতিকথায় শেখ রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন,
‘কদিন বিকেল পাঁচটার দিকে শাঁ করে ৩১ নম্বরের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে ৩২ নম্বরে ঢুকেই আমার সামনে একেবারে পপাতধরণিতল। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ ছেলেটি। …অতঃপর সাইকেলে উঠে লেকপাড়ে উধাও হলো শৈশবের শেষ প্রান্তের ছোট্ট ছেলেটি। …বিকেলে লেকের পূর্বপাড়ে এমনি করে চক্কর মারত। মধ্যবর্তী ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্বপ্রান্তের সাদা একটি দালান পর্যন্ত সাইকেলারোহীর দৌড়ানোর সীমানা। …এদিকে ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মা, তীক্ষ দৃষ্টি রাখতেন দুষ্টু ছেলেটির সাইকেল-পরিক্রমা যেন সীমাবদ্ধ থাকে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণের সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় শিশু রাসেল। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি।
মহাভারতে অভিমন্যুবধ একটা করুন অধ্যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কত অর্বুদ সেনা নিহত হয়েছে, সেই রক্তপাতের বর্ণনার থেকেও বিষাদময় অভিমন্যুবধ। তার প্রধান কারন সেই পুরাকাল থেকেই যুদ্ধে বালক বা শিশুহত্যা নিষিদ্ধ। এমনকী যুদ্ধের কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবেও কোন শিশু নিহত হলে তা নিয়ে হৈ চৈ বাঁধে, বিশ্ব বিবেক সরব হয়। রাসেলের মৃত্যুতে কেঁদেছে তাই মহাপৃথিবী। পরাধীনতার যে চক্রব্যুহ ভেঙে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই অভিশপ্ত চক্রব্যুহের প্রেতাত্মারাই ছদ্মরূপে ঘিরে রেখেছিল পুরো দেশটাকে।
কলির অভিমন্যু অনেকের সঙ্গে রাসেলের নিহত হওয়ার ঘটনা পুরাকালের নিষ্ঠুরতাকেও অতীত করে দিয়েছে। শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হত ৬০ বছর। এর মাত্র পাঁচবছর কম, ঠিক ৫৫ বছর বয়সে একই সঙ্গে নিহত হন কিংবদন্তী মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু। পরিবারের যাঁরা বেঁচে আছেন, তাদের বেদনার রঙ ফিকে হয়নি আজও, হবে না কোনদিন….
ইতিহাসের পাতা বেয়ে আজ আরেক ১৮ অক্টোবর। শেখ রাসেলের ৬১-তম জন্মদিন। শেখ রাসেল যদি বেঁচে থাকত, তাহলে শিশুটি আজ যে মহাযৌবন পাড়ি দিত, তা নিশ্চয়ই বর্ণিল হত বলাই বাহুল্য। বড় হলে কেমন হত সে? সে কি বড় ভাই শেখ কামালের মত ব্যাক্তিত্ববান হত? বাবার মতই কি দীপ্ত হত তার কর্ম? অমনই কি তোজোদৃপ্ত হত কণ্ঠস্বর? তার সন্তানরাও কি সাইকেল চেপে দুরন্তপণা করে বেড়াত ধানমন্ডির লেকের রাস্তায়?
অনন্ত নক্ষত্রবিথীর নিচে, সবশিশুর বাসভূমি এই সবুজ মৃত্তিকায় দাঁড়িয়ে, ক্রন্দনরত হৃদয়ে জানি, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে না।
শুভ জন্মদিন রাসেল। জাতির জন্য তোমার আত্মদান অমর হোক।
জয় বাংলা।
#সংগৃহীত টীম বাংলাদেশ চাও