প্রীতিলতা বসু
সময়টা ১৫ জুলাই মধ্যরাত৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ প্রর্দশন করে৷ যাদের অগ্রভাগে ছিল বর্তমান তথ্য উপদেস্টা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার সমন্বয়ক সারজিস আলম এবং হাসনাত আবদুল্লাহ ৷ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই ছিল সেই বিক্ষোভ৷ বিক্ষোভের শ্লোগান ছিল, “তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার৷”
এটাই তাদের মূল শ্লোগান ছিল৷ অন্তত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেসব সাংবাদিকরা সেই সময় উপস্থিত ছিল, তারা এই শ্লোগানই শুনেছিল৷
পরের দিন দেশ জুড়ে প্রতিবাদ হলো৷ দেশের আপামর জনগন বলতে লাগলো ছাত্ররা কেন নিজেদেরকে রাজাকার বলবে৷ রাজাকার শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিয়েও চলল বিস্তর আলাপ আলোচনা৷ কেউ কেউ বলল, রাজাকার শব্দের অর্থ স্বেচ্ছাসেবক, সময়ের সাথে সাথে এর ব্যাবহারিক অর্থ ও পরিবর্তিত হওয়া উচিত৷
কিংবা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদেই তারা নিজেদেরকে রাজাকার বলেছিল৷ শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে ১৫ জুলাই বলেছিলেন, “মুক্তিযোদ্ধার নাতিরা কোটা পাবে না তো, রাজাকারের নাতিরা পাবে?” আমি উনার বক্তব্যকে সর্মথন করছিনা৷ কোটা সংস্কারের দাবি আদায়ে যারা রাস্তায় নেমেছিল তাদেরকে এইভাবে আক্রমণ করা সমীচীন ছিল না৷
কিন্ত ছাত্ররা নিজেদেরকে কেন রাজাকার বলেছিল? আক্ষরিক অর্থ যাই হউক না কেন, ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে “রাজাকার” শব্দটি এই দেশের মানুষের কাছে এক গালি ছাড়া আর কিছু নয়৷
পরের দিন ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে ছাত্ররা দাবি করলো যে তাদের শ্লোগান ছিল ” তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার, কে বলছে কে বলেছে স্বেরাচার স্বেরাচার “৷ কৌশলগত কারনেই তারা সেদিন তাদের শ্লোগানের বুলি অস্বীকার করেছিল৷
এই শ্লোগান কিংবা বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ যা করেছিল তা অবশ্যই নিন্দনীয়৷ তারা সাধারণ ছাত্রদের উপরে ঝাপিয়ে পরেছিল, যা ছিল আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মত৷
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারকে ডোবানোর জন্য ছাত্রলীগের বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার, অনাচার এবং নেতা, মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রীদের দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যাবহার চুড়ান্ত ভাবে দায়ী৷
আর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের এইভাবে নির্বিচারে হত্যা কোনভাবেই মানা যায় না৷ হতে পারে, শুধু পুলিশ কিংবা আওয়ামী লীগ কর্মীরাই ছাত্রদের মারেন নি৷ অন্য একটা পক্ষ আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে ছাত্রদের হত্যা করেছে৷ এত্তগুলি মানুষের প্রানহানি যাদের হাতে হউক না কেন, দায় আওয়ামী লীগ সরকারকেই নিতে হবে৷ জল ঘোলা হলে, সুযোগ সন্ধানীরা মাছ তো স্বীকার করবেই৷ শেখ হাসিনার প্রথম থেকেই এই আন্দোলনকে গুরুত্ব সহকারে নেয়া উচিত ছিল৷ কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে উনি জনগণের পার্লস বুঝতে পারেননি৷ উনি কি জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছিলেন? কিন্ত তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগে এটা কি করে সম্ভব?
২৯ শে জুলাই, শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভা, আন্দোলনে নিহত এবং আহত ছাত্রদের স্বরণে শোক পালন করার সিদ্ধান্ত নিলেও আন্দোলনকারী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এটিকে প্রহসন উল্লেখ করে প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজেদের প্রোফাইল পিকচার হিসেবে লাল রঙ বেছে নেন। সেদিন এই জাতি আরো বিভক্ত হয়ে পরে৷
৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয় যার মধ্য দিয়ে কোটা সংস্কারকারী আন্দোলনের বিজয় অর্জন হয়, যাকে আন্দোলনকারীরা “দ্বিতীয় স্বাধীনতা” হিসেবে অভিহিত করেছে৷ কিন্ত এটা কি স্বাধীনতা ছিল? বড়জোর এটাকে গণঅভ্যুত্থান বলা যেতে পারে৷ এমনকি বিপ্লব ও নয়৷ বিপ্লব আরো ব্যাপক৷
স্বাধীনতা হলো একটি জাতি, দেশ বা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ অবস্থান বোঝায়; যেখানে তারা অন্য কোন ওপনেবেশিক থেকে নিজেদের মুক্ত করে, সর্বোপরি তাদের একটি নিজস্ব ভুখন্ড হয়৷ বাংলাদেশ তো ১৯৭১ সালেই এর সবই অর্জন করেছিলো৷ তাহলে, এটা কেন স্বাধীনতা হবে৷
তাহলে, এই বিজয় অর্জনকে কেন স্বাধীনতা বলা হচ্ছে? এর উদ্দেশ্য কি হতে পারে? সেটা কি ১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার উপর পর্দা কিংবা প্রলেপ দেয়া কিংবা মুক্তিযুদ্ধের তাতপর্যকে অস্বীকার করা কিংবা যারা মুক্তিযুদ্ধের কথা এলে অস্বস্তিবোধ করে তাদের জন্য স্বস্তির জায়গা তৈরি করা ৷
গত ১লা অক্টোবর ভয়েস অব আমেরিকা প্রধান উপদেস্টার একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে৷ অনুষ্টানের সঞ্চালক যখন ৩২ নম্বর পুড়িয়ে দেয়া, কিংবা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য পুড়িয়ে ফেলা নিয়ে প্রশ্ন করেন৷
উত্তরে প্রধান উপদেস্টা বলেন যে “এভরিথিং ইজ গন, রিসেট বাটনে চাপ দেয়া হয়ে গেছে”..আবার নতুন করে শুরু করতে হবে৷ যথারীতি, এই বক্তব্য নিয়ে হইচই শুরু হয়৷ রিসেট মানে কি? উনি কি মুক্তিযুদ্ধ মুছে ফেলার কথা বলেছেন?
পরে ১০ই অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বিবৃতিতে রিসেট বাটনের ব্যাখা দেয়৷
বিবৃতিতে বলা হয়, ড. ইউনূস ‘রিসেট বাটন’ চাপার কথাটি উল্লেখ করে বলা হয় যে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি, যা বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে, অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে এবং কোটি মানুষের ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার হরণ করেছে, সেটি থেকে বের হয়ে এসে নতুনভাবে শুরু করার কথা বুঝিয়েছেন। তিনি কখনোই বাংলাদেশের গর্বিত ইতিহাস মুছে ফেলার কথা বলেননি।
‘রিসেট বাটন পুশ করেছি; এভ্রিথিং ইজ গন’ এ কথার মধ্য দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের গর্বিত ইতিহাস মুছে দিতে চাননি বলেও জানিয়েছিল প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, যখন আপনি রিসেট বাটনটি টিপবেন, আপনি আবার সব শুরু করার জন্য সফটওয়্যার রিসেট করবেন।
এটি হার্ডওয়্যার পরিবর্তন করে না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের হার্ডওয়্যার সৃষ্টি করে।
কিন্তু রিসেট শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো নতুন করে শুরু করা৷ যেমন ঘড়ি নতুন করে এলার্ম দেয়া৷ যখন আমরা ঘড়িতে নতুন করে এলার্ম দিতে যাই, তখন কিন্ত পুরানোটা আর থাকেনা, পুরানোটা ডিসকার্ড হয়ে যায়৷
১৬ই অক্টোবর, বর্তমান সরকারের এডভাইসরি কাউন্সিল ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসসহ আটটি জাতীয় দিবস উদ্যাপন বা পালন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
অন্যদিবস গুলি হলো: ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, ৫ আগস্ট শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল দিবস, ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস এবং ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।
তথ্য উপদেষ্টা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, যে দিবসগুলি গুরুত্বপূর্ণ নয় সে দিবস গুলি বাতিল করা হয়েছে৷
অথচ, বাংলাদেশে এই আটটি দিবস বাদ দিয়ে এখন থেকে ৭১টি দিবস পালিত হবে৷ এর মধ্যে রয়েছে, আলিঙ্গন দিবস: ১২ ফেব্রুয়ারী, সলঙ্গা দিবস : ২৭ জানুয়ারি, বাংলা ইশারা ভাষা দিবস : ০৭ ফেব্রুয়ারি, জাতীয় বিমা দিবস:২রা মার্চ, পলাশী দিবস : ২৩ জুন, জাতীয় জ্বালানী নিরাপত্তা দিবস: ৯ আগস্ট৷ এই দিবসগুলির চেয়েও কি ৭ই মার্চ কম গুরুত্বপূর্ণ?
কোন দিবস বাদ নিয়ে আমার কোন কিছু বলার নেই, এমনকি ১৫ই আগস্ট ও বাদ দেয়া যায়৷ আওয়ামী লীগের একজন সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই দিন তার পরিবারসহ সামরিক বাহিনীর পথভ্রষ্ট কিছু কর্মকর্তার হাতে পরিবারসহ নিহত হন৷ আওয়ামী লীগ এইদিনটিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যাবহার করে ফয়দা লুটতে পারে, এই আশংকা থেকে এই দিনটিকে এই অন্তর্বতীকালীন সরকার বাদ দিতে পারে৷ কিন্তু ৭ই মার্চ তো কোন দলের দিন নয়, সেইদিন বাঙালি জাতির মধ্যে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার বীজ বোপিত হয়েছিল৷
বর্তমান সরকারের অবস্থান অনুযায়ী, ৭ই মার্চ কোন গুরুত্বপূর্ণ দিন নয়৷ আচ্ছা, ৭ই মার্চের ভাষন না হলে কি বাংলাদেশ স্বাধীন হতো? তাহলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই কি এই সরকারের সমস্যা৷
বিষয়টি আরো পরিস্কার হয়, নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে৷
নাহিদ বলেন, “অবশ্যই শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা না। আমাদের এই ভূখণ্ডের লড়াইয়ের ইতিহাসে কেবল একজন না, অনেকেরই ভূমিকা রয়েছে। আমাদের ইতিহাস কিন্তু শুধু ১৯৫২ থেকেই শুরু হয়নি। আমাদের ইতিহাসে দীর্ঘ লড়াই আছে, ব্রিটিশবিরোধী লড়াই আছে, ১৯৪৭ সালের লড়াই আছে।
উপদেষ্টা নাহিদ আরো বলেন, আমাদের ইতিহাসে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল হাসেম, যগেন মণ্ডল, মাওলানা ভাসানী এমন অনেক মানুষের লড়াই আছে। আমরা তো মনে করি এখানে একজন জাতির পিতা না, বরং অনেক হ ফাদার’স (জাতির পিতা) রয়েছে। যাদের অবদানের ফলে আমরা এই স্বাধীন ভূখণ্ড, স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। সুতরাং, জাতির পিতা হিসেবে আমরা একটা দলের বা একজন ব্যক্তিকে সীমাবদ্ধ করতে চাই না।
মেনে নিলাম, আমাদের ইতিহাসে অনেকের অবদান আছে৷ আওয়ামী লীগ সরকার অনেকের অবদানকেই স্বীকার করেনি৷ তাদের মধ্যে অন্যতম মাওলানা ভাসানী এবং জেনারেল এজিএম ওসমানি৷
ধরে নিলাম উপরোক্ত, যতগুলো নাম আছে উনারা সবাই আছেন, শুধু বঙ্গবন্ধু নেই কিংবা বঙবন্ধুর জন্মই হয়নি৷ তাহলে কি এই দেশ স্বাধীন হতো? হতো না৷
উল্টে-পাল্টে যেভাবেই দেখেন না কেন এইদেশের অস্তিত্বকে স্বীকার করলে ১৯৭১ আসবেই, আমাদের স্বাধীনতা আসবেই৷ এই স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে কিভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দিবেন৷ জাতির জনক ছাড়া স্বাধীনতা কি সম্ভব ছিল? উনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এটাই চিরন্তন সত্য৷ শেখ হাসিনার দু:শাসন কিংবা উনার শাসনামলের ভুল ভ্রান্তি দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান তা মুছে ফেলা যাবেনা৷
পরিশেষে বলব, ১৫ জুলাইয়ে আপনাদের “রাজাকার” শ্লোগান, ৫ই আগস্টের দ্বিতীয় স্বাধীনতা কিংবা ৭ই মার্চকে বাতিল করে দেয়া, এর প্রত্যেক টা বিষয়কে ড: ইউনুসের এই অন্তর্বতীকালীন সরকার ধারন করে৷
এই সবগুলির একটাই অর্থ আপনার মুক্তিযুদ্ধ কে মানেন না, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বে আপনারা বিশ্বাস করেন না৷ আপনাদের স্বরূপ ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে৷ আপনারা আসলে স্বাধীনতা বিরোধী৷ যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কে মানে না তাদেরকে কি বলা যায়, রাজাকার ছাড়া আর কিছুই নয়…শেখ হাসিনা সত্যটাই বলেছিলেন৷
এর পরে কি আপনারা ২৬ শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বরকে বাদ দিবেন? তাইতো মনে হচ্ছে….