ইউনূস সরকারের আমলে নানা পদক্ষেপ আর ঘটনার সমালোচনা করে আসছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এই আইনজীবী। এর প্রতিক্রিয়ায় ইউনূস সরকারের প্রেস সচিব তাকে বুঝেশুনে কথা বলতে বলেছিলেন ফেসবুক পোস্টে। পাঁচ দিনের মাথাতেই হয় মামলা।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে ছাত্র জনতার আন্দোলনের পাশেই ছিলেন প্রবীণ আইনজীবী জেড আই খান পান্না।
তবে সরকার পতনের পর সংবিধানে হাত দেওয়ার চেষ্টা, বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আগুন, মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা নিয়ে জোরাল বক্তব্য রাখা এই আইনজীবীকেও ছাড় দেওয়া হল না। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এই আইনজ্ঞকেও এবার হত্যা মামলার আসামি করা হল।
তার বক্তব্যের ভাষা নিয়ে রুষ্ঠ হয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত ৮ অক্টোবর এক ফেইসবুক পোস্টে হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন। তার বক্তব্যটি ছিল এমন, ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় জেড আই খান পান্নার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু তিনি এখন ইউনূস সরকার নিয়ে এমন সব সমালোচনা করছেন, যা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে যায় না। তার ভাষা সংযত হওয়া উচিত।
এটা স্পষ্টতই ছিল হুমকি। সেটি তার সমর্থকরা মুড়ি মুড়কির মত শেয়ারও করেন।
তবে একজন প্রেস সচিবের সরকার সদস্যের মত এই ধরনের বক্তব্য নজিরবিহীন। আর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হলে সেই পোস্ট তিনি সরিয়ে নেন।
তবে পোস্ট সরিয়ে নিলেও স্ট্যাটাস দেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করা হয় ঢাকার খিলগাঁও থানায়।
সেই মামলার তথ্য এক সপ্তাহ গোপন থাকে। পরে একজন সংবাদকর্মী ফেসবুক পোস্টে এ বিষয়ে লেখেন। জানেন জেড আই খান পান্নাও এ বিষয়ে জানেন। তিনি ভালো আছেন এবং এ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করতে বলেছেন।
মামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন খিলগাঁও থানার ওসি মো. দাউদ হোসেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য না দিতে পারলেও তিনি জানান, গত ১৩ অক্টোবর আবদুল মালেক নামে একজন ব্যক্তি এই মামলাটি করেছেন।
মামলার প্রধান আসামি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মোট আসামি ১৮০ জন। তাকে আইনজীবী পান্না আছেন ৯৪ নম্বরে।
মামলায় বলা হয়েছে, মালেকের ছেলে গত ১৯ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন মেরাদিয়া বাজার এলাকায় গুলিতে আহত হন। পরে তিনি মারা যান।
বীর মুক্তিযোদ্ধা পান্না আন্দোলনের সময় ছাত্রদের পক্ষে ছিলেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান হিসেবে সে সময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে আসছিলেন, শিক্ষার্থীদের পক্ষে আদালতে শুনানিও করছিলেন।
তবে আওয়ামী লীগের পতনের পর আন্দোলনকারীদের মানবাধিকার লঙ্খন ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকায় এই মুক্তিযোদ্ধা রুষ্ঠ হয়ে কঠোর ভাষায় এর নিন্দা করেন।
জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ থাকা অবস্থাতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান কোন এখতিয়াকে দলটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তাদেরকে বঙ্গভবনে নিয়ে গেছেন, সেই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এর জবাব একদিন তাকে দিতে হবে।
সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে কীভাবে গণভবন লুট হয়েছে, কীভাবে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর লুট করে আগুন দেওয়া হয়েছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন, বলেছেন, একদিন এসবের জবাব দিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান নতুন করে লেখার যে কথা বলছে, তারও তীব্র সমালোচনা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ এই আইনজীবী। বলেছেন, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে সংবিধান রচিত হয়েছে, তার ঘোষণাপত্র পাল্টানো যাবে না। যদি করে, তাহলে যুদ্ধ না, মহা যুদ্ধ হবে।
সমন্বয়কদের সবার পাসপোর্ট-ভিসা প্রস্তুত আছে মন্তব্য করে তিনি এও বলেছেন, ‘আমরা এই দেশেই থাকব।’
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার আসার পর সংবাদ মাধ্যম যখন সব কিছুতে তার ধন্য ধন্য করছে, তখন পান্নাই প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে যাচ্ছেন। ইলিশ রপ্তানি না করার ঘোষণা দেওয়ার পরেও কেন দাম বাড়ছিল, তুলেছিলেন সেই প্রশ্নও। পরে অবশ্য সরকার ভারতে রপ্তানির সিদ্ধান্ত ঠিকই নেয়।
মুহাম্মদ ইউনূস যে দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, সেই বক্তব্যেরও তীব্র নিন্দা করেছেন পান্না। বলেছেন, দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। দেশ একবারই স্বাধীন হয়েছে।
পান্না আরও বলেছেন, তারা জাসদ করে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, কিন্তু স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে হয়েছে। এ কথার কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার নতুন ইতিহাস লেখতে চাইছে। তারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মনে করে না, এই কথা খোলাখুলিই বলেছে। বরং তাকে কে জাতির পিতা উপাধি দিয়েছে সে প্রশ্ন রেখেছেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ছাত্রলীগ আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘোষণা করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছিল, সেটি অবশ্য তিনি তিনি জানেন কিনা, সেই প্রশ্ন অবশ্য এরই মধ্যে উঠেছে।
পান্নার বিরুদ্ধে হত্যা মামলায় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বহুবার আসা এক ঘোষণা পড়ে গেল প্রশ্নের মুখে। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, হয়রানিমূলকভাবে কারও বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। তবে পান্নার বিরুদ্ধে মামলায় দুটি বিষয় স্পষ্ট। ১. ইউনূস সরকার কোনো সমালোচনা সহ্য করবে না, ২. মামলাকে অস্ত্র করবে তারা।